আফগানিস্তানে শান্তির যেকোনো খবর বিশ্বজুড়ে স্বস্তি ও আশাবাদ তৈরি করে। কিন্তু অতীতে বারবার এ রকম আশাবাদ হোঁচট খেয়েছে। ফলে খুব সন্দেহবাদী মন নিয়ে সবাই এবারের সংবাদটিও দেখছে। তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো শান্তি-সমঝোতার সংবাদই অন্তত আটটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাধ্য করে। খবরটি হলো, তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শান্তিচুক্তি হতে যাচ্ছে।
চুক্তিতে কী থাকছে
বিষয়বস্তুর দিক থেকে আসন্ন চুক্তি গত সেপ্টেম্বরে যে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, তার মতোই। এটা প্রথাগত কোনো শান্তিচুক্তি নয়। বরং কয়েক স্তরের একটা চুক্তির একাংশ মাত্র। আসন্ন চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকেরা তাৎক্ষণিকভাবে চলে যাবে না। তালেবানরাও এখনই তাদের ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ গড়তে পারছে না। দুটোই অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয় হবে। তারপরও ঠিক হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ২২ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি—সাত দিনের জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে লিপ্ত হবে না উভয় পক্ষ। ‘সহিংসতা কমিয়ে আনা’র এই অদ্ভুত ধাঁচের এই সমঝোতাকে আনুষ্ঠানিক ‘যুদ্ধবিরতি’ও বলা হচ্ছে না। তবে এক সপ্তাহের এই প্রকল্প ‘সফল’ হলে ২৯ ফেব্রুয়ারি বহুল প্রত্যাশিত একটা ‘চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হবে কাতারের দোহায়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সেদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা জালমে খলিলজাদ হয়তো তাতে স্বাক্ষর করবেন। সেপ্টেম্বরে যা হওয়ার কথা ছিল ক্যাম্প ডেভিডে।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিলার বর্তমান সপ্তাহটিকে বলেছেন একটা ‘পরীক্ষামূলক’ পর্যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবান কেউ কাউকে এখনো যে বিশ্বাস করছে না, সেটা স্পষ্ট। ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা কোনো আশাবাদী স্বপ্ন দেখছে না। তবে ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রত্যাশামতো চুক্তি হলে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্যসংখ্যা পর্যায়ক্রমে কমাবে। যদি তালেবান কথামতো সহিংসতা কমায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্যসংখ্যা আগামী ছয় মাসে ৫ হাজার সরিয়ে নেবে। বাকিদেরও সরানো হবে ধাপে ধাপে, আনুমানিক তিন বছর সময়ের মধ্যে। এর মধ্যে তালেবানের বন্দীদেরও ধাপে ধাপে ছাড়তে হবে।
বিনিময়ে তালেবানও নিশ্চিত করবে আল-কায়েদা, আইএস, হাক্কানি নেটওয়ার্ক বা ওরকম সশস্ত্র শক্তিগুলোকে তারা সহযোগিতা করছে না। এর মধ্যেই চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের সঙ্গে তালেবানের আলোচনা শুরু হবে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সেটা শুরু হতে পারে নরওয়েতে। বর্তমান চুক্তি সেই অর্থে কেবল একটা সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির প্রাথমিক শর্ত মাত্র। যখন সবার হাতে বন্দুক থাকবে বটে, তবে ট্রিগারে আঙুল থাকবে না।
এটা কি যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়?
বর্তমানে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার সৈন্য রয়েছে বলে প্রচারিত। আফগানিস্তানে নিজেদের প্রত্যেক সৈনিকের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের বাৎসরিক খরচ প্রায় ১০ লাখ ডলার। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মতে, আফগানিস্তানে ২০০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটনের যুদ্ধ খরচ প্রায় ৯৭৫ বিলিয়ন ডলার; যা এখনো অব্যাহত আছে। এই খরচ আফগান যুদ্ধে সহায়তার জন্য পাকিস্তানকে দেওয়া সাহায্যের অতিরিক্ত। যুদ্ধে তাদের অন্তত ২ হাজার ৩০০ সৈন্য মারা গেছে এবং ২০ হাজার সৈনিক আহত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘকালের যুদ্ধ এটা। একসময় আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যসংখ্যা এক লাখের বেশি ছিল (২০১১)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের পরাজিত করতে পারেনি। ক্রমে তারা বুঝেছে এই যুদ্ধে বিজয় অসম্ভব। ফলে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে এবং এখন প্রতিপক্ষের হাতেই দেশটি দিয়ে যেতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই যাওয়া বিজয়ীর বেশে নয়। বরং এই যাওয়ার পর তাকে সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে—কী অর্জন করতে তারা আফগানিস্তানে এসেছিল?
এটা কি তালেবানদের বিজয়
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সৈনিকটির চলে যেতে এখনো অনেক সময় লাগবে। তবে তার যেকোনো সময়সূচিকে তালেবান নিশ্চিতভাবেই সামরিক বিজয় হিসেবে দেখবে। বিগত বছরগুলোতে তারাই দেশটির বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত। অস্ত্র, জনবল এবং জনসমর্থন কোনো কিছুর প্রবল কোনো ঘাটতিতে পড়েনি তারা। ইতিমধ্যে একধরনের ছায়া সরকারও গড়ে তুলতে পেরেছে। ফলে শান্তি আলোচনা এগোলে আগামী দিনে দেশ ক্রমে তাদের আরও নিয়ন্ত্রণে যেতে থাকবে।
২৯ ফেব্রুয়ারির চুক্তির পর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যেভাবেই হোক তালেবানকে বর্তমান আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। সম্ভাব্য চুক্তির ভাষা সে রকই বলছে। এটা তালেবানের একধরনের নৈতিক পরাজয়। কারণ, এই সরকারকে এত দিন তারা স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এসেছে।
তবে তাদের আসল জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে আসন্ন দিনগুলোতে। দেশকে নেতৃত্ব দিতে হলে পুরো আফগানিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যদি পশতু নেতৃত্ব অন্যান্য জাতিসত্তাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পরিচালনার আস্থা তৈরি করতে না পারে, তাহলে তালেবানদের আজকের ‘বিজয়’ নিরর্থকই হবে।
ন্যাটোর গড়ে তোলা আফগান সরকারের কী হবে
বর্তমান আফগান সরকার অর্থ ও সামরিক শক্তি উভয় অর্থেই ন্যাটোর মদদের ওপর নির্ভরশীল। তার দায়িত্ব হবে ক্রমে দেশে শাসনভার জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে হস্তান্তর করা। দ্রুত এ কাজ শুরু হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সৈনিকটি যাওয়ার আগেই সরকারকে এই কাজ সমাধা করে বিদায় নিতে পারলে ভালো হয়। ইতিমধ্যে সৃষ্ট সমঝোতার ধরন দেখে স্পষ্ট, তালেবানদের সঙ্গে আলোচনায় বর্তমান সরকারকে দুটি বিষয় ফয়সালা করতে হবে। একটা, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং আরেকটা ক্ষমতার হিস্যাসংক্রান্ত চুক্তি। দুটোই দুরূহ, সময়সাপেক্ষ।
ন্যাটো-সমর্থিত এই সরকার এই মুহূর্তে প্রায় দ্বিধাবিভক্ত। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে মানতে অনিচ্ছুক সরকারের প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ। সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, প্রভাবশালী আরেক নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, উজবেক নেতা রশীদ দোস্তামের ছেলে বাতুর দোস্তাম মদদ দিচ্ছেন আবদুল্লাহকে। এ রকম অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে তালেবানের সঙ্গে কারা আলোচনায় বসবে, সেটা নির্ধারণ কঠিন হবে। বিভিন্ন গোত্রপ্রধানদের ‘লয়া জিরগা’ ডেকে একটি প্রতিনিধিদল বাছাইয়ের দিকে যেতে পারে সরকার। তালেবানদের কাছেও তা অধিক গ্রহণযোগ্য হবে।
দেশটির সর্বশেষ নির্বাচন এবং নির্বাচিতদের তালেবানের তরফ থেকে কোনো বৈধতা নেই। ফলে সরকারের অন্তঃকলহ এবং দ্বিধাবিভক্তি তালেবানদের জন্য ভালো সুযোগ। এতে সরকার-সমর্থক রক্ষী দলেও আনুগত্যের প্রশ্নে ভাঙন ধরতে পারে, যা কৌশলগত অবস্থানে এবং দর-কষাকষিতে তালেবানের ভালো অবস্থানে রাখবে।
ন্যাটোর আগ্রাসনে দেশটির যে অভিজাতরা তালেবানের বিরুদ্ধে ছিল, তাদের অনেকেই ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। এদের একাংশ প্রতিহিংসা এড়াতে আপাতত দেশ ছাড়বে বলেই অনুমান করা যায়। ফলে ন্যাটো মদদপুষ্ট বর্তমান সরকার শিগগির আরও দুর্বল হয়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। তার বাড়তি দুর্বলতা মানে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা, যা এ মুহূর্তে আইএস বা আল-কায়েদা ব্যতীত কোনো পক্ষ চাইছে না।
ঠিক এই সময় কেন এই চুক্তি
১৮ মাস আলোচনার পর ঠিক এই সময়ে এসে শান্তির আওয়াজ ওঠা যেন ভবিতব্যই ছিল। বর্তমান সমঝোতার বড় পটভূমি যে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, অনেকেই সেটা বলছেন। ট্রাম্প সরাসরি এটাকে একটা সফলতা হিসেবে দেখাতে চাইবেন। বিষয়টি নির্মম এবং কৌতুককর যে, যুদ্ধ এবং শান্তি দুটোই দরকার হয় শাসকদের। আফগানিস্তানের শান্তির চেয়েও ট্রাম্পের জন্য জরুরি হলো একটা চুক্তি। সেটা যতটা প্রতীকী চরিত্রেরই হোক না কেন। তাঁকে সফলই বলতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিবেচনা থেকেও ট্রাম্পের জন্য এই চুক্তি লাভজনকই বলতে হবে। চুক্তির পরই ন্যাটো সৈন্যদের আফগানিস্তান ছাড়তে হচ্ছে না। বরং তালেবানের হামলা থেকে নিজেদের নিরাপদ করার কিছুটা নিশ্চয়তা পেল তারা। আরেকটি লাভের দিক, তালেবানকে এখন তারা বর্তমান আফগান সরকারের দিকে ঠেলে দিতে পারছে। ফলে ভবিষ্যতের যেকোনো সহিংসতার দায় ওয়াশিংটন ওই দুই পক্ষের ওপর বর্তাতে পারবে।
তবে সর্বশেষ সমঝোতা সম্ভবের ক্ষেত্রে চীন ও পাকিস্তান তালেবানকে উৎসাহ দিয়েছে। এই দুই দেশ তাদের অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে দ্রুত আফগানিস্তানকে যুক্ত করতে আগ্রহী। আর মস্কো আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নতমুখে বিদায়ের যেকোনো দৃশ্যের অন্যতম উৎসাহী দর্শক হতে উদ্গ্রীব। কারণ, একইভাবে তাদেরও যেতে হয়েছিল একদা।
প্রতিবেশী কার কী চাওয়া
যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ের পর আফগানিস্তানে প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকাই হবে মুখ্য। তাদের ইতিবাচক ভূমিকার ওপর শান্তি প্রতিষ্ঠা অনেকখানি নির্ভর করছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা বারবার হোঁচট খাবে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কাবুলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তীব্র প্রতিযোগিতা থাকবে আসন্ন দিনগুলোতে। সেখানে রাশিয়া ও ইরানেরও সুনির্দিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ইরান শিয়া হাজারাদের সরকারে শক্তিশালী অবস্থানে দেখতে চাইবে। ১৯৯৮-এর মতো অবস্থা তারা চাইবে না—যখন মাজার-ই-শরিফে তালেবানদের হাতে তাদের ৯ কূটনীতিকে প্রাণ হারাতে হয়েছিল।
তাজিক ও উজবেকদের সামনে রেখে রাশিয়াও অনুরূপ কিছুই চাইবে। অন্যদিকে, চীন নতুন আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরির কাজগুলো পেতে মরিয়া হয়ে চেষ্টায় আছে। সেটা পেতে হলে তাকেও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ‘নিজস্ব মানুষ’ খুঁজে পেতে হবে। উইঘুরদের কেউ যাতে আফগানিস্তান থেকে সশস্ত্র হয়ে জিনজিয়াংয়ে ঢুকতে না পারে, সেটাও তালেবানের কাছে চীনের চাওয়া। রাশিয়াও একইভাবে তার দেশে চেচেন ও উজবেক গেরিলাদের ফিরতে দেখতে চায় না। এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই গত কয়েক বছর তালেবানকে নীরবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে তারা।
নয়াদিল্লির চাওয়া দ্বিমুখী। তারা কাবুলে বর্তমানের প্রভাব ভবিষ্যতে তালেবান আমলেও বজায় রাখতে আগ্রহী। যুদ্ধ শেষে আফগান মুজাহিদরা যাতে কাশ্মীরমুখী না হয়ে পড়ে, সে বিষয়েও নজরদারি চায় তারা।
শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে ইরান তার দেশ থেকে শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে চাইবে। একই লক্ষ্য পাকিস্তানেরও। এই উভয় দেশে প্রায় ৩০ লাখ আফগান শরণার্থী হিসেবে আছে। অনেক শরণার্থীরই শঙ্কা, অনিশ্চয়তার মধ্যেই তাদের ফেরত যেতে বাধ্য করা হবে।
শান্তি আসবে কী
১৯ বছর হলো সর্বশেষ আফগান যুদ্ধের। সর্বশেষ ২০১৯-এও এই যুদ্ধে ১৪ হাজার গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। তাতে প্রায় ১০ হাজার বেসামরিক মানুষ আহত-নিহত হয়েছে। এর আগেও দেশটিতে যুদ্ধ হয়েছে সোভিয়েত ও ব্রিটিশ সৈনিকদের সঙ্গে। বিদেশি শক্তির সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে আফগানরা নিজেদের মধ্যেও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল দীর্ঘ সময়। আফগান মাটি লাগাতার এসব যুদ্ধে নির্মমভাবে ক্লান্ত এখন। তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা তালেবানরা সেটা ভালো করেই জানে।
কিন্তু সম্ভাব্য চুক্তিটি কি সেখানে শান্তি আনতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে অনেক ‘যদি’ ও ‘তবে’র ওপর। আফগানিস্তানের বিষয়ে তালেবান বা যুক্তরাষ্ট্রই কেবল ‘পক্ষ’ নয়। দেশের অভ্যন্তরে তালেবান ছাড়াও রয়েছে আইএস ও আল-কায়েদা। তারা সহিংসতা চালিয়ে যেতে পারে। আইএস তালেবানদেরও এক বড় প্রতিপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে অসন্তুষ্ট দলত্যাগী তালেবানদের কাছে টানার জন্য আইএস অপেক্ষায় আছে।
আবার জাতিগত দিক থেকে পশতু ছাড়াও হাজারা, তাজিক ও উজবেকরা আফগান সমাজের গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি। এ রকম সবার হাতে অস্ত্র রয়েছে। কোনো অবস্থায় কোনো শক্তি নিজেদের উপেক্ষিত দেখতে চাইবে না।
আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পাশের অন্তত পাঁচ প্রতিবেশীকেও সন্তুষ্ট করার দক্ষতা দেখাতে হবে হবু সরকারকে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও ইরানকে। ভারতসহ ওই দুই দেশ ভবিষ্যতের সরকার গঠনের আলোচনায় নিজ স্বার্থ খুঁজতে তৎপর। এ রকম সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করে একটা প্রশাসনিক ফর্মুলা তৈরি সহজ নয়। ফলে শান্তির সম্ভাবনা বরাবরই ঝুঁকিতে থাকবে। ঘরের এবং বাইরের সব শক্তির সহযোগিতা ছাড়া দেশটিতে দ্রুত স্থিতিশীলতা আশা করা যায় না। চূড়ান্ত স্থিতিশীলতা ও শান্তি অবশ্যই দরকার হবে সব শক্তির অস্ত্রসমর্পণ। আফগানিস্তানের সমাজজীবনের জন্য যা প্রায় অবিশ্বাস্য এক চাওয়া।
ভবিষ্যতের সরকারের রূপ কী হবে
শান্তির স্বার্থে ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানে আরও বহু দিন একটা জাতীয় সরকার প্রয়োজন। দেশটিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেয়েও এ মুহূর্তে জরুরি হলো সশস্ত্রতা কমানো, বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং প্রায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গড়া। এ কাজটি একক কোনো দল পারবে না। বর্তমান আফগান সরকারের একাংশ তালেবান প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে এখনি একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়তে ইচ্ছুক। তবে তালেবান বর্তমান সরকারের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যৌথভাবে কাজের অভ্যাস নেই তাদের। তারা বরং সুষ্ঠু একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলতে পারে। যেখানে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে তারা অংশ নেবে।
তবে এসবই অনুমান। তালেবানরা কীভাবে আফগানিস্তানের ভবিষ্যতে যুক্ত হবে, তা পুরোপুরি অনিশ্চিত এখনো। খুব শিগগির সেই অনিশ্চয়তা কাটার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তবে নাটকীয় অগ্রগতি ঘটাও বিচিত্র নয়। বিশেষ করে যখন চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই নিউইয়র্ক টাইমস সিরাজুদ্দিন হাক্কানির লেখা ছাপল। এই তালেবান নেতাকে ধরতে একসময় যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ২০ ফেব্রুয়ারি দেশের প্রধান কাগজে তাঁর লেখা দেখে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সংবাদপত্র পাঠকই চমকে উঠেছেন। তালেবানদের তরফ থেকে এটা এক করুণ প্রতিশোধই বলতে হবে। কারণ, গত ১৮ বছর এই আমেরিকানদের করের অর্থই ঢালা হয়েছে আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে সিরাজউদ্দিন হাক্কানিদের পরাস্ত করার জন্য। এখন তাদের ক্ষমতায় অভিষেক সম্পন্ন করেই কেবল যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে ফিরে আসতে চায়।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন