ভারতের রাজধানী দিল্লিতে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টি (আপ) বিপুল ব্যবধানে বিজেপিকে হারিয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরেছে। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে আপ দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৩টিতেই জিতেছে। অন্যদিকে বিজেপির আসন গতবারের মাত্র তিনটির চেয়ে সামান্যই বাড়ছে।
দেশটির রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দিল্লিতে এবারের নির্বাচনকে বিজেপি যেভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল সেই চেষ্টা সফল হয়নি—শহরের ভোটাররা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ বা উন্নয়নের কর্মসূচিকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছেন।
কিন্তু কেন্দ্রে ক্ষমতাসীস বিজেপির দিল্লিতে কেন এই ভরাডুবি আর আপের এই বিপুল সাফল্য ভারতের রাজনীতিতেই বা কী তাৎপর্য বহন করছে—এমন প্রশ্ন উঠেছে চারপাশ থেকে।
মাত্র আট নয় মাস আগে গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির সাতটি আসনের মধ্যে সাতটিতেই জিতেছিল বিজেপি। ফলে এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি (এএপি) যে প্রায় নব্বই শতাংশ জিতে নেবে তা দলীয় সমর্থকরাও অনেকে আশা করতে পারেননি।
দলের সদর দফতরে বিজয়োৎসবে সামিল হতে আসা নাজিয়া চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, ‘কেজরিওয়াল জিতবেন এটা জানাই ছিল—কারণ মনেপ্রাণে তার জয় চেয়েই খুব জোরে বোতাম টিপেছিলাম। আর বাস্তবতাও হল, উনি সত্যিই কাজ করেছেন।’
বস্তুত পাড়ায় পাড়ায় সরকারি ডাক্তারখানা বা ‘মহল্লা ক্লিনিক’ চালু করে, সরকারি স্কুলগুলোর ভোল পাল্টে দিয়ে, মেয়েদের বিনা পয়সায় বাসে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার যে দিল্লির মানুষের মনে ছাপ ফেলতে পেরেছেন সেটা আজকের নির্বাচনী ফালাফলেই স্পষ্ট।
কালকাজি আসন থেকে জেতা আপের তারকা ক্যাম্পেইনার আতিশি মারলেনার কথায়, ‘আগামী মেয়াদেও পরিবহন, চব্বিশ ঘন্টা পানীয় জল, বায়ু দূষণ কমানো এবং উচ্চশিক্ষায় জোর দেওয়াটাই হবে দলের অগ্রাধিকার। আসলে কাজ করলে তবেই যে ভোট মেলে, দিল্লি সেটা আবার প্রমাণ করে দিল।’
অথচ দিল্লির শাহীনবাগে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের প্রতিবাদ এবারে দিল্লির নির্বাচনে একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল। রাস্তা আটকে শাহীনবাগ দিল্লিবাসীকে যে অসুবিধায় ফেলছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের অজস্র চেষ্টাও করেছিলেন যোগী আদিত্যনাথসহ বিজেপির শীর্ষ নেতারা।
শাহীনবাগ যে ওখলা কেন্দ্রে অবস্থিত, সেখানে থেকে রেকর্ড ব্যবধানে জেতা আপের আমানাতুল্লা খান বলছেন, ‘এই ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা আজ হেরে গেছে, জিতেছে উন্নয়ন। এটা তো বুঝতেই পারছেন, ওখলার হিন্দু ভাইরাও আমাকে ভোট না-দিলে আমি এত বড় মার্জিনে জিততেই পারতাম না।’
বিজেপি মুখপাত্র বিবেক রেড্ডি অবশ্য মনে করছেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ে কেজরিওয়ালের জুৎসই কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী তুলে ধরতে না-পারা এবং তার সরকারের বিনি পয়সায় জল-বিদ্যুৎ বিলোনোর রাজনীতিই বিজেপির পরাজয়ের কারণ। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগ খন্ডন করে তার যুক্তি, ‘শাহীনবাগে যেভাবে ভারত ভাঙার কথা বলা হচ্ছিল তার প্রতিবাদ আমাদের করতেই হত।’
শিবসেনার নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী আবার মনে করছেন, ‘দিল্লির নির্বাচন এটাই প্রমাণ করে দিল বিজেপির চেয়ে ভাল অপশন থাকলে মানুষ তাকে বেছে নিতে দ্বিধা করবে না। লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির কোনও চ্যালেঞ্জার ছিল না, কিন্তু এখানে বিজেপির সামনে কেজরিওয়াল ছিলেন। শুধু শাহীনবাগে নজর দিয়ে তারা যে বিভাজনের রাজনীতি করতে চেয়েছিল মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
দিল্লিতে হ্যাটট্রিক করে ক্ষমতায় আসা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে এর মধ্যেই অভিনন্দন জানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জির মতো বিরোধী নেতারাও। পশ্চিমবঙ্গে এক সভায় ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মিস ব্যানার্জি এদিন বলেন, ‘এই তো আসার আগে দিল্লিতে আমাদের বন্ধু অরবিন্দকে ফোন করে বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে অজস্র অভিনন্দন জানিয়ে এলাম।’
মমতা আরও বলেন, ‘আমরা কিন্তু সব সময় একসঙ্গেই কাজ করি। ওদিকে বিজেপিকে দেখুন—পুরো সরকার নিয়ে, সব মেশিনারি নিয়ে, টাকার জোর নিয়ে, সব এজেন্সিকে সঙ্গে নিয়েও একেবারে ভোঁকাট্টা হয়ে গেছে। পুরো ভরাডুবি হয়েছে ওদের।’
অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তার দলের এদিনের বিপুল বিজয় ভারতে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিঃসন্দেহে বাড়তি মনোবল জোগাবে। তবে নরেন্দ্র মোদির মোকাবিলায় বিরোধী দলগুলোর ঐক্যকে তা কতটা মজবুত করতে পারবে তা বলার সময় এখনও আসেনি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন