সৌদি আরবে বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে বাঁচার আকুতি জানিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠানোর পর কয়েকজনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক নারী দেশে ফিরেছেন।
বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাওয়া শতাধিক শ্রমিক কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন; যাদের ৮১ জনই নারী। শুধু ২০১৮ সালেই সৌদি আরব থেকে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন। শারীরিক সম্পর্কে রাজি না হওয়ায় সৌদিতে গৃহকর্মীকে নির্যাতনেরঅভিযোগ অনেকের।
এদের মধ্যে একজন পারুল আক্তার (ছদ্মনাম)। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামের বাসিন্দা পারুল। সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে বিয়ের সাত মাসের মাথায় স্থানীয় আদম ব্যবসায়ী মোস্তফা কামালের প্রলোভনে পড়ে গত ২৮ এপ্রিল ঢাকার ফকিরাপুলের সৌদিয়া রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদির দাম্মাম শহরে যান পারুল।
সেখানে যাওয়ার পর গৃহকর্মীর কাজ না দিয়ে যৌনকর্মী হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হয়। দেশে ফিরতে চাইলে তার ওপর নেমে আসে শারীরিক নির্যাতন। নির্যাতনের একপর্যায়ে সৌদির মালিক জানান চার লাখ টাকার বিনিময়ে যৌনকর্মী হিসেবে পারুলকে কিনে নিয়েছেন।
অনেক কাকুতি-মিনতি ও সৌদি মালিকের হাত-পায়ে ধরেও নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে পারেননি পারুল। একাধিক জনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে রাজি না হলে নির্যাতনের অংশ হিসেবে বুকে ও গোপনাঙ্গে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়া হয় তার।
পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তার দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারধর করা হয়। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে জ্ঞান হারান পারুল। এরই মধ্যে একদিন পালিয়ে সৌদি পুলিশের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতাল থেকে নির্যাতনের কিছু ছবি ও ভিডিও স্বামী ও স্বজনদের কাছে গোপনে পাঠিয়ে দেন তিনি।
ওসব ছবি ও ভিডিও দেখে পারুলকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আদম ব্যবসায়ী মোস্তফা কামালকে চাপ দেন স্বজনরা। সেই সঙ্গে বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়। পরে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানালে ছয় মাস ২৬ দিন পর ২৬ নভেম্বর পারুলকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
পারুলের মা বলেন, গত ২৬ নভেম্বর মেয়েকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। দেশে ফিরে সৌদিতে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে জ্ঞান হারায় মেয়ে। এরপর তাকে শ্রীমঙ্গলের মুক্তি মেডিকেয়ারে ভর্তি করা হয়। ভালো মেয়ে বিদেশে গিয়ে এখন মৃত্যুর মুখে।
পারুলের স্বামী বলেন, বিয়ে করেছি সাত মাস হলো। পরিবারে অভাব, দিনমজুরির কাজ করে কোনো রকমে সংসার চলছিল। আদম ব্যবসায়ী মোস্তফা কামালের প্রলোভনে পড়ে স্ত্রীকে সৌদিতে পাঠাই। এমন ঘটবে জানলে জীবনেও স্ত্রীকে সৌদিতে পাঠাতাম না।
তিনি আরও বলেন, সৌদিতে যাওয়ার পর স্ত্রীর ওপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। প্রথম কয়েকদিন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দিলেও পরে বন্ধ করে দেয়া হয়। দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি সে। এরপর নির্যাতের ছবি ও ভিডিও দেশে পাঠায়। ছবি ও ভিডিও দেখে আমরা পাগল হয়ে যাই। পরে বিষয়টি কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানাই। দেশে ফেরার পর এখন তার চিকিৎসা করাচ্ছি আমরা।
শ্রীমঙ্গলের মুক্তি মেডিকেয়ারের প্রধান সেবিকা দীপ্তি দত্ত বলেন, নির্যাতনে ওই নারীর যৌনাঙ্গ, বুক ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোড়া এবং আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সুস্থ হয়ে উঠতে দীর্ঘসময় লাগবে তার।
মুক্তি মেডিকেয়ারের পরিচালক ডা. সাধন চন্দ্র ঘোষ বলেন, অধিক নির্যাতনের ফলে মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেয়েটি। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য একজন মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নেয়া জরুরি।
এ বিষয়ে আদম ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল বলেন, ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গৃহকর্মী হিসেবে ওই নারীকে সৌদিতে পাঠাই। এভাবে আরও অনেক নারী সৌদিতে গেছে। কিন্তু পারুলকে যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের খবর পেয়ে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাকে দেশে আনতে সব ধরনের সহযোগিতা করেছি আমি। বর্তমানে তার চিকিৎসার খরচ দিচ্ছি। এমনকি তার জীবন বীমার টাকা পেতেও এজেন্সির মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশেকুল হক বলেন, সৌদিতে নির্যাতনের শিকার ওই নারীকে মহিলাবিষয়ক অধিদফতর ও সমাজ সেবা অফিসের মাধ্যমে সহায়তা দেয়া হবে। বিষয়টি তদন্ত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন