২০২৪ এ আসছে ভয়াবহ এল নিনো, কি আছে বাংলাদেশের ভাগ্যে? জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীব্যাপী যে সমস্যা বিরাজমান এল নিনো সেই সব সমস্যাকে আরও ত্বরান্বিত করে থাকে। এর সহজ অর্থ হলো, পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এল নিনোর সম্পর্ক রয়েছে তা এখনও প্রমাণিত হয়নি।
এল নিনো সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। যা কয়েক বছর পরপর প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষরেখার দক্ষিণের আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ।
বাংলাদেশেও এল নিনোর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মোখা, হামুন তারপর মিধিলি- এক বছরেই তিন তিনটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে। বর্ষার পরে শীত জাঁকিয়ে বসতে বরাবরই প্রতি বছর কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হয়; ঘূর্ণিঝড়ও হয় মাঝে মাঝে। বিষয়টি অনেকে এখন স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন। কিন্তু এটি মোটেও এতো সহজভাবে নেয়ার মতো নয়।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়াবিদরা বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিতই বটে। কারণ, পৃথিবী এল নিনোর ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এল নিনোর কারণেই প্রকৃতির এলোমেলো আচরণ বেশ অস্বাভাবিকভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এক বছরে তিনটি ঘূর্ণিঝড় এই এলোমেলো আচরণের নজির, যা গত ৫০ বছরেও হয়নি। এর সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে বলেও মনে করেন তারা।
আরও সহজভাবে দেখা যায় এভাবে- আমাদের দেশে সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই শীতের প্রাদুর্ভাব বাড়তে শুরু করতো। কিন্তু এ বছর এখনও মানুষকে ফ্যান চালিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, একের পর এক শক্তিশালী ঝড়, তীব্র বজ্রপাত, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূল অঞ্চলের পানিতে অতি লবণাক্ততাসহ সারা বছরই গরমের আধিক্য আবহাওয়ার বিশাল নেতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে।
এসব নিয়ে বিশ্বনেতাদের যখন লড়াই চলছে তখন আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এল নিনো। শঙ্কা জাগাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে? সেই সাথে জলবায়ু ঝুঁকির তালিকায় বরাবরই এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ আরও বেশি বিপদের মুখে পড়তে পারে, যা আমাদের জন্য বড় দুঃসংবাদ। এল নিনো কি? বিশ্ব উষ্ণায়নের সাথে এর কী সম্পর্ক? বাংলাদেশে এর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা কতটা? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
--এল নিনো আসলে কী?--
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বরাবরই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকির তালিকায় অন্যতম। সেখানে এল নিনোর প্রভাব আরও শঙ্কা জাগাচ্ছে। ১৬ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একদল জেলে প্রথম খেয়াল করেন এ উষ্ণ সমুদ্রজল। এরপর থেকে দুঃস্বপ্নের মতো পৃথিবীতে প্রায়ই ফিরে আসে এল নিনো দশা।
এল নিনো’ সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা; যা কয়েক বছর পর পর হয়। মূলত এটি হচ্ছে, প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষরেখার দক্ষিণের আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ। যা আবহাওয়ার বিশেষ নেতিবাচক অবস্থাকে বোঝায়। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্ব অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে ছাড়িয়ে যায় তখন তাকে এল নিনো বলা হয়।
এর ফলে উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ হারিয়ে যায়। সাধারণত দুই থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হয়। যা ১৮ মাসের বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। বর্তমানে এল নিনোর প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চরম বিপর্যয় বয়ে নিয়ে এসেছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারনা।
এতে পেরু, ইকুয়েডর ও চিলিসহ উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও উপকূলে ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফলে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বহু জায়গায় বৃষ্টিপাত কমে আসবে। দেখা দেবে শুষ্কতা। খরা ও দাবানলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে বাংলাদেশ-ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতে। সাধারণত বাংলাদেশে লা নিনার প্রভাব থাকে। যেটি এল নিনোর বিপরীত চিত্র।
অর্থাৎ পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, তখন তাকে লা নিনা বলা হয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকটি এল নিনোর আবির্ভাব ঘটেছে বিশ্বে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে এল নিনো সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। ওই বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড অতিক্রম করে। এছাড়া ১৯৯৭-৯৮ সালে এল নিনোর প্রভাবে সারা বিশ্বে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঝড় ও বন্যায় মারা গিয়েছিল প্রায় ২৩ হাজার মানুষ।
--এল নিনোর শঙ্কায় কাঁপছে বিশ্ব--
কয়েক বছর ধরে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ দেখছে বিশ্ব। মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে যেখানে এক ফোঁটা পানির জন্য হাহাকার করতে হতো, সেই মরুর বুকে বৃষ্টি আর সবুজের চিত্র ফুটে উঠেছে। অপরদিকে বছরের অধিকাংশ সময়ে ঠাণ্ডা থাকা ইউরোপে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র।
অধিক তাপমাত্রায় যুক্তরাজ্যের রাস্তার সিগন্যাল বাতি গলে যাওয়ার ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অসময়ে অস্বাভাবিকহারে বন্যা, দাবানলে বনাঞ্চল পুড়ে যাওয়া সহজেই বুঝিয়ে দেয় পুরো পৃথিবীই জলবায়ু সংকটে ভুগছে। সেই সাথে বাদ পড়েনি বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ড বাংলাদেশ।
আমাদের এই দেশ নাতিশীতষ্ণ অর্থাৎ শীত গ্রীষ্মে উষ্ণতার পার্থক্য কম থাকবে সেখানে আমাদের এখন সারা বছরই গরম। চলতি বছরের একেকটি মাস শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে উষ্ণতর মাস হিসেবে রেকর্ড হয়েছে যা ইতিহাসের উষ্ণতর বছর হতে যাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন।
বাংলাদেশে আবহাওয়ার ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এল নিনোর প্রভাব- কোনোটা থেকেই রেহাই পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এবার শীত ও গ্রীষ্মকাল দুটোই শুষ্ক। ভারত থেকে মৌসুমি বায়ু দেরিতে প্রবেশ করেছ। ফলে বৃষ্টিপাত কম হবে।
--কেন ২০২৪ সাল ভয়াবহ?--
এল নিনোর প্রভাব পড়তে শুরু করায় পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তনের যে সমস্যায় ভুগছিলো সেই সমস্যা আরও বেগবান হয়েছে। আগামী ২০২৪ সাল ইতিহাসের উষ্ণতম বছর হতে পারেও বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি বছর বাংলাদেশ যে তাপমাত্রার কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে তা আগামী বছর আরও ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত এল নিনোর এই চক্র স্থানীয়ভাবে খরা ও ক্ষুধার পাশাপাশি প্রাণিবাহিত রোগ বাড়াবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। মশার উপদ্রব বাড়বে আরও বহুগুণে। চলতি বছরেই ডেঙ্গুর যে ভয়াবহ অবস্থা তা এখন থেকেই পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
ধানসহ বিভিন্ন ফসল কাটার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এল নিনো। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ এরই মধ্যে ফসল মজুত ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছে। যেমন- ইন্দোনেশিয়ার কিছু অংশ দ্রুত ফসল কাটার পরিকল্পনা করছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বৃহৎ নগরকেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির আশঙ্কায় থাকা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে।
আর এ কারণে এসব এলাকায় অভিবাসীদের আগমনের হার প্রতিবছরই বাড়তে থাকে। যেহেতু এল নিনোর প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে সে হিসেবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা বাড়বে।
দেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের ৪৭ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। ২০১৯ সালের অর্ধবার্ষিকী প্রতিবেদনের হিসাব মতে, দেশের ২৩টি জেলা থেকে প্রায় ১৭ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। যার বেশিরভাগই ঘটেছে বিভিন্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে।
২০৫০ সাল নাগাদ দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। এছাড়াও প্রায় দুই কোটি শিশুর জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানবপাচারের মতো ঘটনা বাড়ার শঙ্কাও রয়েছে বলে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা ‘ডব্লিউএমও’-এর তথ্য অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছর এযাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ সময় পার করতে পারে বিশ্ব।
--সরকার কী করছে?--
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলো ছয়টি ভাগে বিভক্ত। সেগুলো হলো- উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ এলাকা, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা এবং নগর অঞ্চলগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার ২০২৩ সালে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।
‘জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন’ বলতে পরিবেশ, সমাজ, জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কমিয়ে আনতে সরকার এবং সাধারণ মানুষ যেসব পদক্ষেপ নিয়ে থাকে তা বোঝায়। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে ১১টি ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু বিপদাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে তা মোকাবিলায় ১১৩টি উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৩-৫০ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২৩০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে।
উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ যেমন মোকাবিলা করা যাবে, পাশাপাশি প্রায় ১.১ মিলিয়ন হেক্টর জমি জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা থেকে রক্ষা পাবে। এদিকে, প্রতি বছর বিশ্বনেতাদের সাথে বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে। কপ বলতে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের বার্ষিক সম্মেলনকে বোঝানো হয়ে থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বৈশ্বিক পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৯২ সালে ১৯৮টি সদস্য রাষ্ট্র এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে অভিযোজন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর জন্য আরও সহনশীল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন