যার হাঁকডাকে বন কাঁপে, সেই বনের রাজাই নাকি কাঁপছে পিঁপড়ার ভয়ে। বিস্ময়কর জীব জগতে অনেক কিছুই ঘটে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এক গবেষণার ফল থেকে জানা গেছে, এক ধরনের ক্ষুদে আক্রমণাত্মক পিঁপড়া কেনিয়ার সাভানাতে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে। তাদের কারণেই নাকি শিকারের পদ্ধতি বদলাতে বাধ্য হয়েছে বনের রাজা সিংহ।
বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, একপ্রকার খুদে আক্রমণাত্মক পিঁপড়া কেনিয়ার সাভানাতে এমন এক নাটকীয় রূপান্তর ঘটিয়েছে যে এটি স্থানীয় সিংহগুলোকেও বাধ্য করেছে সেগুলোর শিকারের পদ্ধতি বদলে ফেলতে।
গবেষণায় আক্রমণাত্মক প্রজাতির বিভিন্ন প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন প্রাণী অথবা পোকামাকড়ের যেভাবে বাসস্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন ঘটে, এই ক্ষুদ্র আক্রমণাত্মক পিঁপড়ার কারণে সাভানাতে এইরকম ঘটনাই ঘটছে।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ টড পামার বলেছেন, "প্রায়ই আমরা দেখতে পাই যে ছোট জিনিসগুলোই পৃথিবী শাসন করে।" তিনি মধ্য কেনিয়াতে সিংহের শিকারের অভ্যাসের উপর বড় মাথার পিঁপড়ার প্রভাব শনাক্তকারী গবেষণা দলের অংশ ছিলেন।
তিনি বলেন, "এই খুদে আক্রমণাত্মক পিঁপড়াগুলি সম্ভবত ১৫ বছর আগে দেখা গিয়েছিল এবং আমরা কেউই লক্ষ্য করিনি কারণ তারা মানুষ সহ বড় প্রাণিগুলোর প্রতি আক্রমণাত্মক নয়। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে এগুলো ধ্বংসাত্মক ভাবে প্রাকৃতিক দৃশ্যের খুব সূক্ষ্ম উপায়ে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।"
কেনিয়ার লাইকিপিয়ার সমতল ভূমির শিস-কাঁটাযুক্ত একাশিয়া গাছ থেকে পিপড়াগুলোর এই আক্রমণ শুরু হয়েছে। এই কাঁটাযুক্ত গাছগুলো স্থানীয় একাশিয়া পিঁপড়ার সাথে পারস্পরিকভাবে উপকারী সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। গাছগুলো পিঁপড়াদের জন্য আশ্রয় ও খাবার সরবরাহ করতো এবং এর বিনিময়ে পিঁপড়াগুলো ক্ষুধার্ত হাতিদের হুল ফুটিয়ে গাছ থেকে দূরে রাখতো।
কিন্তু বড় মাথার পিঁপড়াগুলো সব বদলে দিয়েছে। ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপে জন্মানো এই পিঁপড়া মানুষ এবং পণ্যের চলাচলের মাধ্যমে এই অঞ্চলে এসেছিল বলে মনে করা হচ্ছে। এই আক্রমণাত্মক পিঁপড়াগুলো প্রায় দুই দশক আগে এসেছিল এবং একাশিয়া পিঁপড়াগুলোকে হত্যা করতে শুরু করেছিল। ফলে শিস-কাঁটা গাছগুলো তৃণভোজীদের কাছে অরক্ষিত হয়ে পরেছিল।
এভাবে গাছে সংখ্যা কমতে থাকে এবং তা সিংহের জন্য সমস্যা তৈরি করে কারণ সিংহগুলো শিকারের জন্য, বিশেষ করে জেব্রাকে অতর্কিতে আক্রমণ করার জন্য গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতো। গবেষকরা কেনিয়ার ওল পেজেটা সংরক্ষণে তিন বছর ব্যয় করেছেন জিপিএস কলার দিয়ে সিংহের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আক্রমণাত্মক পিঁপড়াদের এলাকায় এরা কীভাবে বাস করছে তা জানার জন্য।
সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, বড় মাথার পিঁপড়ার জন্য জেব্রা হত্যা তিনগুণ হ্রাস পেয়েছে। পরিবেশবিদ মেরেডিথ পামার (যিনি গবেষণায় জড়িত ছিলেন না) বলেন, "এই গবেষণাটি বাস্তুতন্ত্র কত জটিল হতে পারে তার একটি সুন্দর চিত্রায়ণ। এটি এই ধারণা দেয় যে, একটি সামান্য সুতো ধরে টান দিলে পুরো সিস্টেমই প্রতিক্রিয়া দেখায়।"
গবেষকরা বিস্মিত হয়েছিলেন কারণ পিঁপড়ার প্রভাবে সিংহের জনসংখ্যা হ্রাস পায়নি। এটি ভালো সংবাদ কারণ এই অঞ্চলে সিংহের জনসংখ্যা ইতোমধ্যেই আনুমানিক ১ লাখ থেকে কমে গিয়ে ২ হাজারে এসে ঠেকেছে। গবেষণার প্রধান লেখক ওয়াইমিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডগলাস কামারু বলেছেন, পিঁপড়াদের আক্রমণে বড় বিড়াল শিকার এবং শিকারের কৌশল পরিবর্তন করেছে। সিংহগুলো এখন দলবদ্ধ হয়ে বড় মহিষ শিকার করে।
যদিও সিংহরা এখন পর্যন্ত মানিয়ে নিয়েছে, বড় মাথার পিঁপড়ারা অন্যান্য প্রজাতির জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে যেহেতু জিরাফ বা বিপন্ন কালো গন্ডারের মতো প্রাণীগুলো এই একাশিয়া গাছের উপর নির্ভর করে। এজেন্স ফ্রান্স-প্রেসকে ডগলাস কামারু বলেছেন, "প্রশ্ন হল, সামনে কী ঘটবে?" সিংহের পরিবর্তিত খাদ্য সেগুলোর নিজস্ব বাস্তুসংস্থানে প্রভাব ফেলতে পারে। পামার বলেন, "আমরা এখনও জানি না যে সিংহের শিকারের কৌশলের এই গভীর পরিবর্তনের ফলে কী হতে পারে।"
গত বছর জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত জাতিসংঘের কনভেনশনের জন্য আন্তঃসরকারি বিজ্ঞান উপদেষ্টা প্যানেল ৩৭ হাজারের বেশি তথাকথিত এলিয়েন প্রজাতির (যেই প্রাণীগুলো নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য কোন নতুন এলাকায় বাসস্থান গড়ে তুলে) তালিকাভুক্ত করেছে যেগুলো তাদের মূল বাসস্থান থেকে অনেক দূরে অবস্থান নিয়েছে৷
প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি অনেক আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে যা বছরে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন এই পরিস্থিতিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২০০ বছরে আক্রমণাত্মক প্রজাতির এইরকম আক্রমণাত্মক হওয়ার ঘটনা অথবা বাসস্থান পরিবর্তন করার ঘটনার অন্তত এক তৃতীয়াংশ ১৯৭০ সাল থেকে ঘটেছে।
গত বছরের নভেম্বরে একটি ভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে চিতার শিকারের অভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে। গবেষকরা দেখেছেন, দ্রুতগতির বিড়াল যেগুলো সাধারণত দিনের সময় শিকার করে সেগুলো উষ্ণ আবহাওয়ার সময় ভোর এবং সন্ধ্যার দিকে শিকার করতে বাধ্য হয়। এটি তাদের বেশিরভাগ নিশাচর প্রতিযোগী শিকারি যেমন সিংহ এবং লেপার্ডের সাথে আরও সম্ভাব্য সংঘর্ষে জড়িয়ে ফেলছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন