হিমালয়কন্যা নেপাল। যেন রহস্যমণ্ডিত এক জগত। এখানকার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলেই পাওয়া যায় বিশেষ এক ধরনের মধু । এটা খেলে আপনার ভিতরে অদ্ভুত এক মাদকতার সৃষ্টি হবে। নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি খেয়ে ফেললে আপনি জ্ঞানও হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাই তো এর নাম ম্যাড হানি বা ‘পাগলা মধু'। কী আছে এই মধুতে?
যখনই আমরা মধুর কথা কল্পনা করি তখনই চিকিৎসা ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের কথা সামনে আসে। পাঁচ হাজার বছরের অধিক সময় ধরে মানুষ মধুকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করছে। সাধারণত মধুকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হলেও নেপাল ও তুরস্কে একধরনের মধু পাওয়া যায়, যা সাধারণ মধু থেকে অনেকটা আলাদা। যাকে ‘পাগলা মধু’ বলা হয়।
পাগলা মধু আমাদের পরিচিত মধুর মতোই। কিন্তু পাগলা মধুর চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার ছাড়াও ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই মধুর হ্যালুসিনোজেনিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অর্থাৎ এই মধু পান করলে খুব দ্রুত ভ্রম সৃষ্টি হবে। এর জন্য বেশি পরিমাণ মধু পান করতে হবে এমন নয়। সামান্য মধু পান করলেই ভ্রম সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া মাথা ধরাও শুরু হতে পারে।
পাগলা মধুর মাদকতার কথা হাজার হাজার বছর আগে থেকেই জানা যায়। ৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সেনা প্রধান পাগলা মধু পান করায় এশিয়ার মাইনরের রাজা মিথ্রিদাতেসের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। মিথ্রিদাতেস কৌশলে রোমান সৈন্যদের পাগলা মধু পান করান। এতে তাদের মাদকতা চলে আসে। সুযোগ বুঝে মিথ্রিদাতেস তাদের আক্রমণ করে পরাজিত করেন।
পাগলা মধু পান করলে মাথা ধরা ছাড়াও রক্তচাপ হ্রাস পাওয়া এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন শুরু হতে পারে। যার ফলে মধু পানকারীর বমিবমি ভাব, অসাড়তা, দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া, সংজ্ঞা হারান এবং হঠাৎ স্ট্রোক হতে পারে। এমনকি নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি মধু পানে মৃত্যুও হতে পারে। তবে সচরাচর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে না।
পাগলা মধু পান করলে যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেগুলো মূলত এই মধুতে থাকা গ্রায়ানোটক্সিনের জন্য ঘটে। গ্রায়োনোটক্সিন একধরনের নিউরোটক্সিন। যা স্নায়ু ও পেশির ওপর কাজ করে। এই গ্রায়োনোটক্সিন সাধারণত রডোডেনড্রন জাতীয় উদ্ভিদের ফুলে পাওয়া যায়। রডোডেনড্রন ফুলকে নেপালের জাতীয় ফুল বলা হয়।
মৌমাছি যখন রডোডেনড্রন উদ্ভিদ থেকে মধু সংগ্রহ করে তখন সেই মধুর বৈশিষ্ট্য অনেক ভিন্ন হয়। তবে রডোডেনড্রন উদ্ভিদের ফুল এবং অন্যান্য উদ্ভিদের ফুলের মিশ্রণ থেকে মধু সংগ্রহ করলে এই পাগলা মধু তৈরি হয় না। বিশ্বে ৭০০ এর অধিক প্রজাতির রডোডেনড্রন উদ্ভিদ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ২-৩ প্রজাতির উদ্ভিদে গ্রায়ানোটক্সিন থাকে। তুরস্কের ব্লাক সি’র আশপাশের আর্দ্রতা ও পর্বতের ঢালু অংশ এই উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য খুবই উপযোগী।
তুরস্কের লোকেরা মনে করেন পাগলা মধু উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ম্যালিটাস এবং পেটের বিভিন্ন ধরনের রোগ সারাতে খুবই কার্যকর। এছাড়াও যৌন মিলনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতেও তাদের অনেকেই এই মধু ব্যবহার করেন। বর্তমানে পাগলা মধু ভায়াগ্রার বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে বলে জানা যায়। পাগলা মধু তুরস্ক ছাড়াও নেপাল থেকেও সংগ্রহ করা যায়। নেপালের কুলুং উপজাতিরা দলবল নিয়ে খুবই উঁচু পর্বত থেকে এই মধু সংগ্রহ করে।
নেপালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মৌমাছির প্রজাতি Apis dorsata laboriosa এই পাগলা মধুর জোগান দেয়। মৌমাছিগুলো মধু সংগ্রহ করে উঁচু পাহাড়ের গায়ে মৌচাকে জমা করে। সেখান থেকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে কুলুং উপজাতিরা। মৌচাকের কাছে পৌঁছার জন্য এরা দড়ি দিয়ে তৈরি মইও ব্যবহার করেন। মৌমাছির হুল ফোটানো থেকে বাঁচতে গ্রীষ্মকালে সোয়েটার আর ট্রাউজার পরিধান করে।
কেউ কেউ মশারি ব্যবহার করে। মূলত হাতের কাছে যেসব পোশাক পায় সেগুলোই এরা ব্যবহার করে। পাশাপাশি লম্বা বাঁশ ব্যবহার করে মৌচাকে ধোঁয়ার ব্যবস্থা করে। তবুও কিন্তু এরা মৌমাছির দংশন থেকে খুব একটা রেহাই পায় না। ধোঁয়া পেয়ে মৌমাছি সরে গেলে এরা মৌচাক কেটে মধু সংগ্রহ করে। পাগলা মধু সংগ্রহকারী কুলুং উপজাতিদের জীবনমান মধু সংগ্রহ করে উন্নত হয়নি। এটি তাদের প্রধান পেশাও নয়। তবে ধর্মীয় বিশ্বাস ও লোকাচার থেকেই তারা এগুলো সংগ্রহ করেন।
নানাবিধ ভেষজ গুণসম্পন্ন পাগলা মধু সংগ্রহ করে কুলুংদের জীবনমান উন্নত না হলেও তাদের কাছ থেকে মধু ক্রয় করে যিনি বাইরের দেশে বিক্রি করেন তার অবস্থার ঠিকই উন্নতি হয়েছে। মধু সংগ্রহে জীবনের ঝুঁকি ও আর্থিক মূল্য কম পাওয়ায় কুলুংদের অনেকেই আজকাল পাগলা মধু সংগ্রহ করা ছেড়ে দিয়েছেন।
অনেকেই আবার ছাড়ার জন্য মনস্থির করেছেন। সুতরাং আমদানি-রপ্তানিকারকদের অতিরিক্ত মুনাফার চিন্তা থেকে বিরত থাকা উচিত। এছাড়াও মধু সংগ্রহে আধুনিক যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা উচিত। অন্যথায় এই প্রাচীন ঐতিহ্যও একদিন হারিয়ে যাবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন