ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের মাথায় উঠে যারা শাবল দিয়ে আঘাত করেছিলেন তাদের একজন বলবীর সিং। একটা সময় তার মনে ছিল মুসলমানদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ আর প্রবল ঘৃণা। বলবীর সিং ছিলেন হিন্দু ধর্মান্ধ জনতার একজন। যারা ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ১৬ শতকে নির্মিত বিখ্যাত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিলেন। এক সময় শিবসেনার সক্রিয় এই কর্মী আজ একজন মুসলিম। নাম পাল্টে হয়েছেন মোহাম্মদ আমির। মুখো লম্বা দাড়ি রেখে আল্লাহর নাম জপেন সব সময়।
৩২ বছর আগে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের গম্বুজে উঠে শাবলের ঘা মারা শিবসেনার সক্রিয় কর্মী বলবীর সিং এখন মোহাম্মদ আমির। আল্লার নাম জপেন সব সময়। ভোরে আজান দেন। লম্বা দাড়ি রেখে তিনি এখন পুরো দস্তুর মৌলভি। প্রায়শ্চিত্ত করতে ভেঙে পড়া শ’খানেক মসজিদ সংস্কার করতে চান তিনি। এক সময় শিবসেনার সক্রিয় কর্মী বলবীর সিংহ বাবরির মাথায় শাবল চালিয়ে সব খুইয়েছিলেন। বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। স্ত্রীও শোনেননি তার কথা,তার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেননি।
বাবার মৃত্যুর পর বাড়ি ফিরে শুনেছিলেন- বাবা নাকি বলে গিয়েছিলেন তার দ্বিতীয় সন্তানের (বলবীর) মুখ যেন বাড়ির কেউ আর না দেখেন। এমনকী বলবীরকে যেন তার বাবার মুখাগ্নিও করতে না দেয়া হয়। বলবীরের বন্ধু যোগেন্দ্র পালেরও একই দশা। ৩২ বছর আগে যিনি বলবীরের সঙ্গেই উঠেছিলেন বাবরির মাথায়। শাবলের ঘায়ে ভেঙেছিলেন মসজিদ। বহু দিন আগে তিনিও হয়ে গেছেন পুরোদস্তুর মুসলিম।
বলবীর জানান, তার পরিবার কোনও দিনই উগ্র হিন্দু ছিলেন না। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ইংরেজি, এই তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি পাওয়া বলবীর তার মা, বাবা, ভাই, বোনদের নিয়ে ছোটবেলায় থাকতেন পানিপথের কাছে খুব ছোট্ট একটা গ্রামে।
বলবীরের বয়স যখন ১০, তখন তিনি ও তার ভাইদের পড়াশোনার জন্য বলবীরের বাবা দৌলতরাম তাদের নিয়ে চলে যান পানিপথে। তার বাবা বরাবরই গান্ধীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি দেশভাগ দেখেছিলেন। তার যন্ত্রণা বুঝেছিলেন। তাই আমাদের আশপাশে যে মুসলিমরা থাকতেন, উনি তাঁদের আগলে রাখতেন সব সময়। কিন্তু পানিপথের পরিবেশটা ছিল অন্য রকম। হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা লোকজনরা তেমন মর্যাদা পেতেন না পানিপথে। ফলে একটা গভীর দুঃখবোধ সব সময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত বলবীরকে।
সেই পানিপথেই একেবারে অচেনা, অজানা আরএসএসের একটি শাখার কর্মীরা বলবীরকে দেখা হলেই ‘আপ’ ‘আপ’ (আপনি, আপনি) বলে সম্বোধন করতেন। বলবীর বলছেন, সেটাই আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেই থেকেই ওদের (আরএসএস ) সঙ্গে আমার ওঠবোস শুরু হয়। শিবসেনা করতে করতেই বিয়ে করি। এমএ করি রোহতকের মহর্ষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওই সময় প্রতিবেশীরা ভাবতেন আমি কট্টর হিন্দু। কিন্তু বাবা কোনও দিনই মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করতেন না। আমরা কোনও দিনই যেতাম না মন্দিরে। বাড়িতে একটা গীতা ছিল ঠিকই, কিন্তু আমি বা আমার ভাইয়েরা কেউই সেটা কখনও পড়িনি।
পানিপথে কেউ বাঁ হাতে রুটি খেলেও তখন তাকে ‘মুসলিম’ বলে হেয় করা হয়। শিবসেনার লোকজনদের কাছ থেকে ‘সম্মান’ পেয়ে তাদের ভালো লেগে যায় বলবীরের। শিবসেনাই তাকে অযোধ্যায় পাঠিয়েছিল বাবরি ভাঙতে। পাঠিয়েছিল বলবীরের বন্ধু যোগেন্দ্র পালকেও। তারা হয়ে যান করসেবক।
বলবীর জানিয়েছেন, বাবরি ভেঙে পানিপথে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে তাকে ও যোগেন্দ্রকে তুমুল সংবর্ধনা জানানো হয়। তারা যে দু’টি ইট এনেছিলেন বাবরির মাথায় শাবল চালিয়ে, সেগুলি পানিপথে শিবসেনার স্থানীয় অফিসে সাজিয়ে রাখা হয়। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতেই তেড়ে আসেন বলবীরের বাবা দৌলতরাম।
বলবীরের কথায়, বাবা আমাকে বললেন, হয় তুমি এই বাড়িতে থাকবে, না হলে আমি। তো আমিই বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। আমার স্ত্রীও বেরিয়ে এল না। থেকে গেল বাড়িতেই। ওই সময় ভবঘুরের মতো জীবন কাটিয়েছেন বলবীর। লম্বা দাড়িওলা লোক দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠতেন তখন। বেশ কিছু দিন পর বাড়িতে ফিরে জানতে পারেন, বাবা মারা গিয়েছেন।
তিনি বাবরি ভাঙায় যে দুঃখ পেয়েছিলেন বাবা, তাতেই নাকি তার মৃত্যু হয়েছে। এর পর পুরনো বন্ধু যোগেন্দ্রের খোঁজখবর নিতে গিয়ে আরও মুষড়ে পড়েন বলবীর। জানতে পারেন, যোগেন্দ্র মুসলিম হয়ে গেছেন। যোগেন্দ্র নাকি তখন বলবীরকে বলেছিলেন, বাবরি ভাঙার পর থেকেই তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। যোগেন্দ্রর মনে হয়েছিল পাপ করেছিলেন বলেই সেটা হয়েছে।
প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে তাই মুসলিম হয়ে যান যোগেন্দ্র। এর পরেই আর দেরি না করে সোনেপতে গিয়ে মাওলানা কালিম সিদ্দিকির কাছে মুসলিম ধর্মে দীক্ষা নেন বলবীর। হয়ে যান মহম্মদ আমির।
‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে বলবীর সিং ওরফে মহম্মদ আমির ভেঙে পড়া শ’খানেক মসজিদকে মেরামত করতে চান। বলবীরের দাবি, ১৯৯৩ থেকে ২০১৭, এই ২৪ বছরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে মেওয়াটে বেশ কিছু ভেঙে পড়া মসজিদ খুঁজে বের করে সেগুলির মেরামত করেছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসের কাছে মেন্ডুর মসজিদও স্থানীয় মুসলমানরে নিয়ে নাকি সংস্কার করেছেন বলবীরই।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন