বাংলাদেশ ও ভারতের মতো উপমহাদেশের দেশগুলির অনেকের কাছে এখনও স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। সুন্দর ও উন্নত জীবনের আশায় আটলান্টিক পাড়ের দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। কিন্তু আমেরিকার সেই চাকচিক্য ভরা দিন কি শেষ হয়ে এসেছে?
দ্য ইকোনমিস্টের খবর বলছে, খোদ আমেরিকানরাই এখন দেশ ছাড়ছেন। পরিবার নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন দূরের দেশে। কেন? কি হয়েছে সেখানে? হঠাৎ কেন মাতৃভূমি ত্যাগ করতে শুরু করেছেন আমেরিকানরা? কোথায়ই বা যাচ্ছেন তারা? এক সময় মানুষের স্বপ্নের ঠিকানা ছিল আমেরিকা। পড়াশোনার জন্য হোক বা কাজের সন্ধানে–আমেরিকা পাড়ি দিতেন অনেকেই।
কিন্তু বর্তমানে দিন পাল্টেছে। খোদ আমেরিকানরাই তাদের নিজের দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন দূরদেশে। তবে ইউরোপের দেশগুলোতে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আমেরিকান বসতি গড়েছেন। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে বসবাসকারী আমেরিকানের সংখ্যা সাড়ে ১৫ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজারে। পর্তুগালে এই সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে ১০ হাজার হয়েছে। এ ছাড়াও ২০২২ সাল পর্যন্ত স্পেনে বসবাসকারী আমেরিকানের সংখ্যা ৩৪ হাজার।
এ ছাড়া ২০২২ সালে ডেনমার্কে ৪৬৮৯ জন, সুইজারল্যান্ডে ৪৫১৩ জন, আয়ারল্যান্ডে ৩৮৩১ জন, চেক রিপাবলিকে ২৫১৩ জন আমেরিকানকে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশেও গত কয়েক বছরে আমেরিকার প্রবাসীদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৩ সালে ব্রিটেনে বসবাসকারী আমেরিকানদের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার, ২০২১ সালে তা হয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার। এদিকে, শুধু গত বছরেই আমেরিকা থেকে চার হাজারের বেশি মানুষ ডেনমার্ক এবং সুইজারল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছেন।
কিন্তু কী কারণে আমেরিকানরা দেশ ছাড়ছেন তা অনুসন্ধান করে বেশ কিছু কারণ ওঠে এসেছে। কারো কারো মতে, আমেরিকায় মানুষের জীবনযাত্রার মান আগের চেয়ে কমে গিয়েছে। স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারছেন না অনেকেই। উন্নত জীবনধারার খোঁজে তাই ইউরোপে যাচ্ছেন তারা।
আমেরিকায় বাড়িভাড়া বা থাকার খরচ আগের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে জমির দামও। নাগরিকদের বেতন বা রোজগার সেই অনুপাতে বাড়েনি। ইউরোপের দেশগুলোতে এই খরচ অপেক্ষাকৃত কম। এ ছাড়া আমেরিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নাগরিকদের দেশ ছাড়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনেকেই দেশের রাজনৈতিক ডামাডোলে বিরক্ত। তবে এ ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। আমেরিকার কয়েকটি সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন–এমন প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলেন অনেকেই। এরপর ২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সত্যি সত্যিই অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যান। বারাক ওবামার আমলে ১১ শতাংশ, ট্রাম্পের আমলে ১৬ শতাংশ আমেরিকান ইউরোপে চলে গিয়েছেন।
২০২২ সালের মধ্যে এই পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১৭ শতাংশ। কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও আমেরিকার চেয়ে এগিয়ে ইউরোপ। পরিসংখ্যান বলছে, আমেরিকায় চাকুরিজীবীদের কাজের গড় সময় বছরে ১৮১১ ঘণ্টা। অন্যদিকে ইউরোপে এক বছরে ১৫৭১ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। আমেরিকা ছাড়ার নেপথ্যে অন্য আরেকটি কারণ বর্ণবিদ্বেষ। আমেরিকান সমাজের বড় সমস্যা এটি। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের এখনও নিচু নজরে দেখে সমাজের একাংশ।
২০২১ সালে জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর অনেক কৃষ্ণাঙ্গই আমেরিকান ইউরোপে চলে গিয়েছিলেন। তবে আমেরিকা থেকে ইউরোপে গিয়ে সেখানে থিতু হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা গিয়েছে করোনা অতিমারি-পরবর্তী কালে। আমেরিকায় থাকার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিক থেকে সমস্যায় পড়েছেন অনেকেই। অতিমারির পরে সার্বিক ভাবে আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও নড়বড়ে। সরকারের ওপর ঋণের বোঝা চেপেছে।
দেউলিয়া হয়েছে একের পর এক জনপ্রিয় ব্যাঙ্ক। অনেকেই তাই আমেরিকায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। ইউরোপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আরও ইন্ধন জুগিয়েছে সরকারের এই অর্থনৈতিক জটিলতা। ইউরোপের যে দু’টি দেশকে অনেক বেশি সংখ্যক আমেরিকান জীবনের জন্য বেছে নিয়েছেন, সেগুলো হলো পর্তুগাল ও স্পেন। এ ছাড়া অন্য ইউরোপীয় দেশেও আমেরিকানদের ভিড় বাড়ছে।
সূত্র: সিএনএন
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন