ভারতের মনিপুর রাজ্যের যে দুই নারীকে নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরানোর ভিডিও নিয়ে সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে, তাদেরই একজনের স্বামী শুক্রবার আক্ষেপ করে বলেছেন তিনি ভারতের সেনাবাহিনীতে ছিলেন, কার্গিল যুদ্ধ করেছেন, অথচ স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারলেন না। ওই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মনিপুর পুলিশ জানিয়েছে, আর মূল অভিযুক্তের বাড়ি বৃহস্পতিবার রাতে ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় নারীরা।
যে প্রাচীন নারী সংগঠনটির সদস্যরা মূল অভিযুক্তের বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন, সেই ‘মেইরা পেইবেই’ ওই দুই নারীকে নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটানো এবং তার ভিডিও করার গোটা ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে। 'মেইরা পেইবেই' শব্দের অর্থ যে নারীরা মশাল হাতে সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ঘটনাচক্রে যাদের নিগ্রহ করা হয়েছে, তারা কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ, আর অভিযুক্তরা মেইতেই সম্প্রদায়ভুক্ত। আবার যে নারীরা ওই অভিযুক্তের ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছেন, তারাও মেইতেই।
অভিযুক্তদের ফাঁসির দাবীও তুলেছে অতি শক্তিশালী ও সামাজিক আন্দোলনগুলির সামনের সারিতে থাকা মনিপুরের নারী সমাজ। তারা বলছেন মনিপুরী সমাজে যে নারীদের এত শ্রদ্ধা করা হয়, মায়ের সম্মান দেওয়া হয়, সেই নারীজাতি, হলেনই বা তারা কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদের সঙ্গে কীভাবে এই ঘটনা ঘটাতে পারল অভিযুক্তরা?
--'পুলিশ হাজির ছিল, কিন্তু তারা কিচ্ছু করে নি'-- সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে যে দুই নারীকে নগ্ন করে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে দেখা গেছে, তাদের একজনের বয়স ৪০এর ওপরে, অন্যজন ২০-২৩ বছর বয়সী। যার বয়স ৪০এর ওপরে, তারই স্বামী শুক্রবার কথা বলেছেন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে। তিনি সেনাবাহিনীর আসাম রেজিমেন্টের সুবেদার ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি কার্গিল যুদ্ধ দেখেছি, ভারতীয় শান্তিবাহিনীর হয়ে শ্রীলঙ্কাতেও ছিলাম।
আমি দেশ রক্ষার কাজ করেছি, অথচ অবসর নেওয়ার পরে নিজের স্ত্রী এবং গ্রামের আরেক নারীকে রক্ষা করতে পারলাম না।“ ওই অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারের কথায়, “চৌঠা মে সকালে জনতা এসে এলাকার বেশ কিছু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, দুজন নারীকে বিবস্ত্র করে দেওয়া হয় আর গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য করা হয়।
সেখানে পুলিশ হাজির ছিল, কিন্তু তারা কিচ্ছু করে নি।“ পুলিশের বিরুদ্ধে ঘটনা চলাকালীন কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনই থানায় একাধিকবার অভিযোগ দায়ের করা সত্ত্বেও অভিযুক্তদের গত তিনমাস গ্রেপ্তার করা হয় নি কেন, সেই প্রশ্নও তুলছেন মানবাধিকার কর্মীরা। ইম্ফলের মানবাধিকার কর্মী কে. অনিল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “এফআইআর বেশ কিছুদিন পরে দায়ের করেছে নিগৃহীতা ঠিকই, অনেক সময়েই এধরনের ঘটনায় অভিযোগ দায়ের করতে পরিবার একটু সময় নেয়।কিন্তু পুলিশ অভিযোগ পাওয়ার পরেও তিনমাস কিছু করল না এটাই আশ্চর্যের।“
“আবার দেখুন ঠিক যেদিন সংসদের অধিবেশন শুরু হবে, তার আগের দিনই ভাইরাল হয়ে গেল, আবার তিনমাস প্রধানমন্ত্রী চুপ করে থাকলেন, একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না, আর এই ঘটনাটা নিয়েই তিনি সংসদ ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করলেন! এটা কি নিতান্তই সংযোগ? এই প্রশ্ন কিন্তু আমাদের রাজ্যের মানুষের মনে ঘুরছে,” বলছিলেন মানবাধিকার কর্মী কে অনিল।
মনিপুরে নগ্ন হয়েছিলেন নারীরা, প্রতিবাদ জানাতে মনিপুরে সবসময়েই নারীরাই প্রতিবাদের মুখ হয়ে থেকেছেন। সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন বা আফস্পার বিরুদ্ধে যেমন ইরম শর্মিলা ছানু ১৬ বছর ধরে অনশন করেছেন, তেমনই ২০০৪ সালে থাঙজাম মনোরমা নামে এক নারীকে আসাম রাইফেলস তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার ঘটনার বিরুদ্ধে ওই বাহিনীর সদর দপ্তর কাংলা ফোর্টের সামনে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন ১২ জন নারী।
তাদের সামনে ব্যানার ধরা ছিল, ‘ভারতীয় সেনা, এসো আমাদের ধর্ষণ কর।’ ওই প্রতিবাদের ছবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেদিন সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছিলেন যে নারীরা, তাদের বেশিরভাগই প্রয়াত। ওই প্রতিবাদীদের একজন ছিলেন লাইশ্রাম জ্ঞানেশ্বরী দেবী। বিবিসি বাংলাকে মিসেস জ্ঞানেশ্বরী দেবী বলছিলেন, “আমরা তো সেদিন নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম নারীদের ওপরে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে।
আজ এই ৭৩-বছর বয়সে এসে আমাকে দেখতে হচ্ছে যে দুজন নারীকে এই মনিপুরেই প্রকাশ্যে নগ্ন করে হাঁটানো হচ্ছে, তাদের ওপরে অত্যাচার করা হচ্ছে!” “হতে পারে তারা কুকি, কিন্তু তারা তো নারী। কেন এ ঘটনা হল? অভিযুক্তদের চরম শাস্তি দেওয়া হোক, ওদের ফাঁসি দেওয়া হোক,” বলছিলেন জ্ঞানেশ্বরী দেবী। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম মনিপুরের অতি শক্তিশালী নারী সমাজ কেন ঘটনার পরে দীর্ঘ তিন মাস চুপ করে থাকল, কেন তারা প্রতিবাদ জানাল না?
মিসেস জ্ঞানেশ্বরী দেবী বলছিলেন, “আমরা তো কেউ জানতামই না এত বীভৎস ঘটনা হয়েছে। আমার মনে হয় না যদি আগে জানা যেত ঘটনাটা তাহলে মনিপুরের নারীর চুপ করে থাকত।যখনই জানা গেছে কে মূল অভিযুক্ত, তার ঘরবাড়ি তো ভেঙ্গে জ্বালিয়ে দিয়েছে মনিপুরী নারীরাই।“
তারা না হয় জানতে পারেন নি ঘটনার কথা, কিন্তু জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে এই ঘটনাটি সহ নারী নিগ্রহ এবং যৌন হেনস্থার ছয়টি ঘটনার উল্লেখ করে অভিযোগ জানানো হয়েছিল বলে সংবাদ পোর্টাল নিউজলণ্ড্রি জানিয়েছে। অনলাইন পত্রিকাটি লিখেছে, নর্থ আমেরিকান মনিপুর ট্রাইবাল অ্যাসোসিয়েশন জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে ইমেইল মারফত অভিযোগ করেছিল ১২ই জুন। নিগৃহীতাদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জেনে তারা মহিলা কমিশনে অভিযোগ করেছিল।
কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। যদিও জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা বলছেন তারা অভিযোগটি পেয়েছিলেন এবং মনিপুর পুলিশের কাছে চারবার চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কোনও চিঠিরই উত্তর আসে নি বলে জানিয়েছেন মিজ শর্মা।
সূত্র : বিবিসি
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন