বাংলাদেশে এটমিক রিসার্চ

বাংলাদেশে এটমিক রিসার্চ

একটি জাতির উন্নতির অন্যতম হাতিয়ার হলো গবেষনা এবং উদ্ভাবন খাতে দক্ষতা। যে জাতি এতে যত বিনিয়োগ করতে পারবে, তার সফলতা এবং উন্নতির হারও তত বেশি। স্বভাবতই দরিদ্র-অনুন্নত দেশ গুলোতে রিসার্চ এবং ডিজাইন খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে কম।আমাদের দেশের প্রক্ষাপটেও এর খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। তবে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কিছু কিছু খাতে আমাদের দেশের গবেষনা বিশ্বমানের। যার একটি যে কৃষি তা আমরা অনেকেই জানি। তবে গবেষনার খাত হিসাবে বাংলাদেশে এটমিক রিসার্চ সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানেন। যেমন যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান কোনটি? তাহলে অনেকেই হয়তো উত্তর দিতে পারবেন না!

কিংবা যদি জিগ্গেস করা হয় বাংলাদেশের একমাত্র পারমানবিক গবেষনা চুল্লির সস্পর্কে অনেকে হা করে থাকবে!এধরনের কিছু যে বাংলাদেশে আছে কিংবা থাকতে পারে তাই কল্পনায় নেই অনেকের!(যারা জানেননা তারা লেখাটা পড়তে থাকুন!) সাধারণত পারমানবিক রিসার্চের কথা শুনলেই আমাদের বেশিরভাগ মানুষের চোখে ভেসে উঠে পারমানবিক বোমা তৈরি কিংবা বেশি হলে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা।

কিন্তু প্রকৃত পক্ষে শান্তিপূর্ন এবং মানব কল্যানে পারমানবিক শক্তির বিবিধ ব্যবহার রয়েছে। তার পরিসর চিকিৎসা হতে শুরু করে কৃষি, শিল্প, পেট্রোলিয়াম, বিভিন্ন এলয়,পলিমার, এনার্জি তথা বিদ্যুৎ উৎপাদন সহ অসংখ্য সেক্টর জুড়ে।

বাংলাদেশে এটমিক রিসার্চের ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যায় পাকিস্তান আমলে বেশিরভাগ পারমানবিক গবেষনা সংক্রান্ত প্রতিস্ঠান এবং স্হাপনা গড়ে উঠে পশ্চিম পাকিস্তানে। তাই দেশ স্বাধীন হবার পর দেখা গেল বাংলাদেশে পেল 'আনবিক শক্তি কেন্দ্র' এর অধীনে একটি সেকশন কৃষি গবেষনা খাতের একটা রিসার্চ সেন্টার এবং তিনটি নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেন্টার। তো দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফিরেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দূরদৃষ্টিতে বুঝতে পেরেছিলেন পারমানবিক গবেষনার গুরত্ব তাই।

১৯৭২ সালেই পারমানবিক কৃষি গবেষনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরির সেই সেকশনকে পরিনত করলেন 'পরমানু কৃষি ইনিস্টিটিউট(ইনা) নামের প্রতিস্ঠানে। তারপরের বছরই(১৯৭৩) উনার নির্দেশে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ন কাজে পরিচালিত সকল পারমানবিক গবেষনা কাজের নিয়ন্ত্রক প্রতিস্ঠান হিসেবে প্রতিস্ঠা হয় 'বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশন' । 'ইনা' ১৯৭৫ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্হানান্তর করা হয় যা পরবর্তিতে পরিনত হয় 'বিনা' নামে। এ থেকে 'বারি' এবং 'ব্রি' নামের পরিপূর্ন কৃষি গবেষনা প্রতিস্ঠানে রূপ লাভ করে। আর আমরা সবাই জানি এ প্রতিস্ঠানগুলো বাংলাদেশের কৃষি গবেষনায় নতুনজাত উদ্ভবন এবং চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবনে সবচেয়ে সফল প্রতিস্ঠান।

এবার আশাযাক বাংলাদেশের সবচেয় বড় এবং সবচেয়ে স্পর্শকাতর গবেষনা প্রতিস্ঠান 'পারমানবিক শক্তি গবেষনা সংস্হা বা AERE সস্পর্কে। তার আগে সংক্ষেপে বাংলাদেশে পারমানবিক গবেষনা প্রতিস্ঠানগুলোর পরিচালনা এবং কাঠামো সম্পর্কে জানা যাক।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের অধীন 'বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশন' দেশের সবধরনের পারমনবিক রিসার্চ,এক্টিভিটি, প্রতিস্ঠান সমূহকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে। এর অধীনে প্রধানত পাঁচটি প্রতিস্ঠান রয়েছে। এগুলো হলো: ১/ পরমানু শক্তি কেন্দ্র,ঢাকা। ২/পরমানু শক্তি গবেষনা সংস্হা, সাভার। ৩/স্পেস রিসার্চ এন্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশন(স্পারসো)। ৪/ পররমানু শক্তিকেন্দ্র, চিটাগং। ৫/বাংলাদেশ ইনিস্টিউট অব এটমিক এগ্রিকালচার (বিনা)।

এদের মধ্যে 'পরমানু শক্তি গবেষনা সংস্হা,সাভার' হলো সবচেয়ে বড়ো এবং দেশের একমাত্র রিসার্চ পারমানবিক রিয়্যাক্টরটি এখানেই অবস্হিত। এটি বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশনের অধীনে ১৯৮৬ সালে সাভারে এটি প্রতিস্ঠা করা হয়। এতে স্হাপন কর হয় ৩ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন "TRIGA Mark-2' মডেলের একটি পারমানবিক রিএক্টর। রিএক্টরটিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ১৯.৭% পরিশোধিত ইউরেনিয়াম-২৩৫। এতে প্রায় ১০০টি ফুয়েল ইলিমেন্ট রড রয়েছে।এর মধ্যে ৯৩টি ফুয়েল রড। এতে বোরন-কার্বাইডের তৈরি ছয়টি কন্ট্রোল রড রয়েছে। এই প্রতিস্ঠানের অধীনে রয়েছে মোট ১১টি ইনিস্টিটিউট এবং ইউনিট।

এগুলো হলো: 1. Institute of Nuclear Science and Technology (INST)

2. Institute of Food and Radiation Biology (IFRB)

3. Institute of Electronics (IE)

4. Institute of Computer Science (ICS)

5. Reactor Operation and Maintenance Unit (ROMU)

6. Nuclear Minerals Unit (NMU)

7. Tissue Banking and Biomaterial Research Unit 'defres' (TBBRU)

8. Energy Institute (EI)

9. Central Engineering Facilities (CEF)

10. Scientific Information Unit (SIU)

11. Training Institute (TI)

এগুলোর আর বিস্তারিত লিখতে গেলে এটা বিশাল লেখায় পরিনত হবে। তাই আর সেদিকে না যেয়ে সংক্ষেপে দেখা যাক এখানে কি ধরনের গবেষনা এবং কাজ করা হয়। ১/এখানে সারা বাংলাদেশের হসপিটাল গুলোর জন্য তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ যেমন আয়োডিন-১৩১,মলিবডিনাম-৯৯, টেকনিটিয়াম-৯৯এম উৎপাদন এবং সরবরাহ করে থাকে। এগুলো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের রোগ শনাক্তকরন টেষ্ট এবং ক্যান্সার সহ অন্যন্য রোগের রেডিয়েশন থেরাপিতে ব্যবহৃত হয়।

২/এখানে বিভিন্ন পদার্থের পারমানবিক গঠন, প্রকৃতি নির্নয়। নতুন ধরনের এলয়,কম্পোজিট মেটারিয়াল,সিরামিক, শিল্ড মেটারিয়াল নিয়ে গবেষনা ও পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন মৌলিক এবং প্রায়োগিক বিষয়ে গবেষনা হয়। ৩/ বিভিন্ন ধরনের রেডিয়েশন মাপক যন্ত্রের ক্যালিব্রেশন এবং মান নিয়ন্ত্রন। ৪/ দেশের বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় উপাদান অনুসন্ধান এবং তা সনাক্ত এবং গবেষনা। ৫/ কৃষিখাতে রেডিয়েশনের মাধ্যমে নতুন জাত,রোগবালাই দমন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষনা। ৬ পরিবেশ দূষন যেমন দেশের মাটির নিচের আর্সেনিক, ভারী ধাতু দূষন, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের ফলে তেজস্ত্রিয় দূষন এবং পরিবেশের উপর প্রভাব গবেষনা। ৭/বিভিন্ন পরিক্ষা মূলক সেমিকন্ডাক্টর উপাদান যেগুলো ইলেকট্রনিক্সে ব্যবহৃত হয় তা নিয়ে গবেষনা।

৮/ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ৈর এসংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষনার পরীক্ষানীরিক্ষায় সহায়তা এবং ছাত্রদের থিসিস,গবেষনায় হাতে কলমে প্রশিক্ষন সহ ইত্যাদি। এভাবে এখানে অসংখ্য বিষয়ে গবেষনা চলে থাকে। এর ধরন,পদ্ধতি হিসেবে নিউট্রন স্ক্যাটারিং, নিউট্রন রেডিওগ্রাফি,নিউট্রন এক্টিভেশন এনালাইসিস সহ অসংখ্য গবেষনা পদ্ধতি পরিচালনা করা হয়। যেগুলো মৌলিক গবেষনা হতে শুরু করে, চিকিৎসা,কৃষি,শিল্প,নিরাপত্তা,এবং কৌশলগত গোপন রাস্ট্রীয় গবেষনা হয়ে থাকে। তো দেশের এ মূল্যবান স্পর্শকাতর এবং সর্ববৃহৎ গবেষনা প্রতিস্ঠানে ব্যবহৃত পারমানবিক চুল্লিটি এখন পর্যন্ত বড় কোন দূর্ঘঠনা ছাড়াই গত ৩৬ বছর ধরে নিরাপদে ব্যবহার করে আসছে। তো সম্প্রতি সরকার এ চুল্লিটির আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।

গত শতাব্দীর এনালগ প্রযুক্তিতে চলা পারমানবিক চুল্লিটির কন্ট্রোল ব্যবস্হা উন্নয়ন, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত এবং ডিজাটাইজেশনের জন্য দক্ষিন কোরিয়ার সাথে চুক্তি করেছে। যার নিউজ অলরেডি অনেকেই দেখেছেন। আশাকরা যায় আধুনিকায়নের পর এতে আরো বৃহৎ পরিসরে গবেষনা কার্যক্রম চালানো যাবে এবং দেশ ও জাতীর জন্য নতুন সাফল্য বয়ে আনবে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password