চরফ্যাশনে মুজিব বর্ষের ঘরের আদ্যোপান্ত - বিডিটাইপের প্রতিনিধি সালমানকে জানিয়েছেন চরফ্যাশন উপজেলা প্রশাসক, চরফ্যাশন উপজেলায় গত ছয় মাস ধরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় মুজিব বর্ষের ঘরের নির্মাণ কাজ চলছে।
এগুলি তৃতীয় পর্যায়ের ঘর। শুরু হয়েছে কচ্ছপিয়াতে ঘর নির্মাণের মধ্য দিয়ে। এই ঘর গুলি নির্মাণে উপজেলা প্রশাসন চরফ্যাশন সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে মনিটরিং করছে। ঘর গুলি নির্মাণে সরকার যে গাইড লাইন দিয়েছে সেগুলি অক্ষরে অক্ষরে মেনে এই কাজ গুলি করা হচ্ছে। এছাড়াও গুণগত মান ভালো রাখার জন্য উপজেলা প্রশাসন স্ব উদ্যোগে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি সেগুলির বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হল:
১# যে রড ব্যবহার করেছি সেগুলি ১২ মিলি, ১০ মিলি, ০৮ মিলি পরিমাপের রড। ডিজাইনে রড যেভাবে ব্যবহার করার কথা বলেছে ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। আর রড গুলি গ্রেডের রড একে tmt (Thermo mechanically treated) রড বলে থাকে। 500W, 60ksi মানের রড এগুলি। ব্র্যান্ড aks, mks, bsrm. শুধু একটা সাইটে tmt বারের পরিবর্তে সেমি অটো রড ব্যবহার করা হয়েছে কারণ সেসময় মার্কেটে tmt রড ছিল না। সেমি অটো রড মোটামুটি ভালো মানের রড এতে ওয়েট একটু বেশি।
২# সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে সেভেন রিংস সিমেন্ট এবং সেভেন রিংস না পাওয়া গেলে প্রিমিয়ার সিমেন্ট। সেভেন রিংস হলো portland composite cement যাতে ক্লিংকার থাকে ৬৫ থেকে ৮০% । এসব সিমেন্ট দিয়ে মানুষ তাদের ব্যক্তিগত বাড়ি ঘর বানানোর কাজে প্রচুর ব্যবহার করে থাকে।
৩# ১ নম্বর ইট ব্যবহার করা হয়েছে। ইট নিয়ে পূর্বে যেসব অভিযোগ ছিল তার প্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরপরও বাজে ইট আসলে এগুলি ব্যবহার করা হয় নাই।
৪# টিন ব্যবহার করা হচ্ছে ৩৬ মিলিমিটার রঙিন টিন। এই টিনগুলি অনেক টেকসই ও মজবুত। ব্যবহার করা হচ্ছে আবুল খায়ের, মুরগী মার্কা, ky স্টীল, ও টিকে গ্রুপের টিন। আশা করি দেশে এর চেয়ে স্বনামধন্য টিনের ব্র্যান্ড খুব একটা নেই।
৫# খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে ১ নম্বর ইট দিয়ে তৈরি পিকেটস খোয়া। **বালি ব্যবহৃত হচ্ছে একলাস্পুর বালি। এর থেকেও দামী বালি মার্কেট এ আছে তবে সেগুলি ঘরের বাজেট অনুযায়ী ইউজ করা সম্ভব হবে না।
০৬# এবার আসি কাঠের প্রসঙ্গে: ইট, রড, সিমেন্টের গুরুত্বের থেকেও এসব ঘরে ভালো কাঠ ব্যবহারের গুরুত্ব সর্বাধিক কারণ কাঠ দ্রুত নষ্ট হয়ে গেলে টিন বাতাসে উড়ে চলে যাবে। টিন যদি না থাকে তাহলে ঘরের দেয়াল দাড়িয়ে থাকলে কী লাভ। এসব প্রসঙ্গ বিবেচনায় নিয়ে মেহগনি কাঠের তৈরি "আরা", "রূপা" ও "ভাগা" ব্যবহার করা কয়েছে।
৭# টিন সেটিং করতে এক ধরনের পেরেক ব্যবহৃত হয় একে বলে টোপ পেরেক। এই পেরেকের নিচে একটা রাবার ব্যান্ড দিতে হয় নইলে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢোকার চান্স থাকে! বাজারের সবচেয়ে দামী টোপ পেরেক ব্যবহার করা হয়েছে।
০৮# বাথরুমের প্লাস্টিক দরজা আরএফএল কোম্পানির।
০৯# লোহার দরজা ও জানালা বানানোর পরে এতে রড অক্সাইড দিয়ে প্রলেপ দেয়া হয়। এটা না করলে এতে মরিচা ধরে। এছাড়াও প্রতিটি দরজার লোহার হুক চিরে দুই পার্ট করে দেয়া হয় যাতে এগুলি সিসি দেয়ালের ভিতরে অত্যন্ত শক্তভাবে এটে থাকে। হুক চিরে দুই পার্ট করে দেয়া দেয়া আমার উদ্ভাবন বলতে পারেন। এগুলি গ্রিল মিস্ত্রি করতে চায় না। কারণ এসব কাজ ব্যক্তিগত কাজেও কেউ করেনা আর আমাদেরতো সরকারি কাজ। তাকে নিয়মিত ফোন করে এসব জিজ্ঞেস করা হয়। হুক চিরে দুই পার্ট করে দিলে এতে করে দরজা খুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে না। এসব নির্দেশনার সবটা নির্মাণ সংক্রান্ত গাইড লাইনে নেই তারপরও এসব করা হচ্ছে গরীব মানুষের কথা এসব বিষয় মাথায় নিয়ে।
১০# এবার আসি রিং স্লাবের বিষয়ে: প্রতিটি ঘরের জন্য দুটি আলাদা পিটে মোট ১০ টি রিং ব্যবহার করা হয়।
#১১ অধিকাংশ ঘর নির্মিত হচ্ছে খাস জমিতে। ৩৪০ টি ঘরের মধ্যে ২৭০ টি ঘর খাস জমিতে আর মাত্র ৭০ টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে ক্রয় করা জমিতে। সে হিসেবে ৮.১০ একর খাস জমি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে যার বাজার মূল্য ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। খাস জমি উদ্ধার করে এসব ঘর নির্মাণ করায় সরকারের সেইভ হচ্ছে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। খাস জমি উদ্ধার করা বেশ দুরুহ একটা কাজ। যারা দখলদার তারা সহজে এসব জমি ছাড়তে চায় না। এসব জমি খাস জমি উদ্ধার উপজেলা প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। আমরা শুরুতেই ভেবেছিলাম সরকারের খাস জমি উদ্ধার করে গৃহহীনদের জন্য ভালো কাজে নিয়োজিত করবো। তাই এসব জমি উদ্ধার করতে পেরেছি। খাস জমিতে গৃহ নির্মাণ করতে প্রথমেই ট্রাক চলাচলের জন্য একটা রাস্তা বানাতে হয়। এসব রাস্তা নির্মাণের কোনো বরাদ্দ থাকে না। চলমান সব গুলি সাইটে এসব সংযোগ রাস্তা নির্মাণ করেই কাজ করা হচ্ছে।
# উপকারভোগী বাছাই করার আগে আমরা মাইকিং করি যেন ঘরের জন্য তারা কাউকে কোনো টাকা পয়সা না দেয়। এতে আমরা ভালো ফলাফল পেয়েছি। এসব ঘর বরাদ্দে অর্থ লেনদেন কোনো ভাবেই হচ্ছে না। সঠিক ভাবেই ভূমিহীন যার ১০ শতাংশের নিচে জমি আছে শুধু তাদেরকেই ঘর দেয়া হচ্ছে। আমাদের এসব ঘরে ইতিমধ্যেই ঠাই পেয়েছে প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যক্তা, ঘর-জামাই, বিধবা, অন্যের জমিতে বসবাসকারী, অসহায় ও সম্বলহীন, দুস্থ ছোট পরিবার। # এরপরও কিছু বিষয় থাকে যেগুলি আমাদের হাতে নেই। যেমন আমরা যেভাবে গরীব লোকের গৃহ নির্মাণের বিষয়ে অনেক গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি কিন্তু রাজ মিস্ত্রি সেভাবে কিন্তু ভাবে না। আসলে তাদের তেমন কোনো দায়বদ্ধতা নেই। অনেক সাইটে গিয়ে দেখেছি তারা তৈরি করা মসলা রোদে ফেলে রেখেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা! অনেক সময় দেখেছি মসলা ওয়ালে না দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে কারণ তার ক্লান্তি লাগছে! অনেক সময় দেখেছি ঢালাই এর রং লাল। অর্থাৎ তারা খোয়া ভালো করে ধুয়ে ব্যবহার করে নি। প্রতিটি সাইটে এক বা একাধিক মোটর আছে পানি ব্যবহারের জন্য কিন্তু তারা করতে চায় না। আমরা এগুলি ভিডিও কলের মাধ্যমে যথা সম্ভব পর্যবেক্ষণ করি। মিস্ত্রি বলে স্যার সরকারি কাজ এর চেয়ে আর ভালো হয় না। জানি এটা তাদের মাইন্ড সেট আপ হয়ে গেছে। তাই অনেক সময় এসব মিস্ত্রি নিয়ে কাজের ফাঁকে বৈঠক করে উদ্দীপনা তৈরি করার জন্য বক্তব্য দিয়েছি। এখন তাদের মনোভাব বেশ পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এছাড়াও এসব মিস্ত্রিদের সাথে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তিও করেছি। গৃহহীনদের জন্য এসব ঘরের নির্মাণ কাজ ধর্মীয় কাজের মতোই গুরুত্বপূর্ন। চরফ্যাশনে এসব অসহায় সুবিধা বঞ্চিত মানুষের ঘরের যে কাজ হচ্ছে তা বাংলাদেশের যে কোনো উপজেলার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন