গ্রামেগঞ্জে মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া যায়। কিন্তু আগের মতো আর টাকা-পাওয়া যায় না। মানুষ আর ওসবে বিশ্বাসও করতে চায় না। অন্য কাজেও মন বসে না। তাই পুকুর, খাল, নদীতে মানুষের স্বর্ণ ও রুপা হারিয়ে গেলে খুঁজে বেড়াই। রোজ সকালে বিভিন্ন গ্রামে আসি। স্বর্ণ ও রুপা খুঁজে পেলে তার বিনিময়ে টাকা নেই। কি আর করা! বেঁচে থাকার আর কোনো উপায়ও নেই। এটিই এখন পেশা।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বেদে-ডুবুরি আরিফ সরদার।
শরীয়তপুর সদর উপজেলার আংগারিয়া বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় আরিফের সঙ্গে। তার সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন। তাদের বয়স ৩০-৩৩ কোটায় সীমাবদ্ধ। তিনজনের কাঁধে ঝাই আছড়া (খাঁচি) ও রয়েছে বাইসাইকেল। তিনজনের আয়-রোজগারের সম্বল এগুলোই।
এমন চিত্র এখন শরীয়তপুর জেলায় সহসাই চোখে পড়ে না। আগে বেদে-ডুবুরিরা দলবেঁধে গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় এভাবেই স্বর্ণ, রুপা তুলতেন।
বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সদর উপজেলার চর ডোমসার মুন্সিরহাট বেদেপল্লীতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেকেই আর এই পেশায় থাকতে চাইছেন না। এখানে প্রায় ৬ শতাধিকের মতো বেদের বসবাস। পূর্ব পুরুষেরা নৌকায় বসবাস করলেও দুই দশক আগে চর ডোমসার গ্রামে ঠিকানা গড়েন তারা। ক্রমেই তা বিস্তৃত ঘটছে। পরিবর্তন ঘটছে আবাসস্থলেরও। এদের মধ্যে প্রায় আড়াই শতাধিক বেদে জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ভোটার হয়েছেন।
চর ডোমসার মুন্সিরহাট বেদেপল্লীতে ৫০ জনের মতো জলাশয়ে হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণ, রুপা খুঁজে দেয়ার কাজ করেন। আগে এ পেশায় ছিল প্রায় ২০০ জনের মতো। ১৫০ জন পেশা পরিবর্তন করেছেন।
একসময় নৌকায় বসবাস করা মানুষগুলো এখন গৃহস্থের ন্যায় পাকা, আধাপাকা ও টিনের বাড়িতে বসবাস করছেন। কেউ কেউ দোতলার ভিত্তি দিয়েও বাড়ি নির্মাণ করছেন। পরিবর্তন এসেছে বেদে পেশাতেও।
জেলার আংগারিয়া, ডামুড্যা, পন্ডিতসার, নড়িয়া, চাকধ, কার্তিকপুর, গোসাইরহাটে বেদে সম্প্রদায়ের দেখা মেলে। কেউ পল্লীর মধ্যে দোকান দিয়েছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ এখন দেশের বাইরে শ্রম দিয়ে টাকা পাঠাচ্ছেন।
চর ডোমসার মুন্সিরহাট বেদেপল্লীর ডুবুরি রইজ সরদার সাংবাদিককে বলেন, ‘আমরা আগে নৌকাতেই থাকতাম। দেশে দেশে ঘুরতাম। তাই স্কুল, কলেজ ও মসজিদে পড়তে পারিনি। এখন বাড়িঘর করার কারণে ছেলেমেয়েরা স্কুল, কলেজ ও মসজিদে পড়তে পারছে। আমরা স্বর্ণ-রুপাসহ বিভিন্ন গয়না খুঁজি। বর্তমানে কাজ কমে গেছে।’
এটিএম শামসুজ্জামান সরদার বলেন, ‘আগে স্বর্ণ-রুপাসহ বিভিন্ন গয়না তুলতাম। এখন পুকুর, খাল বালু ও মাটি দিয়ে ভরাট হচ্ছে। কাজ কমে গেছে। তাই এ পেশা ছেড়ে শ্রমজীবীর কাজ করি।’
ডুবুরি আশরাফ আলী সরদারের স্ত্রী আলো মতি বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী পানি থেকে স্বর্ণ, রুপা গয়না খোঁজেন। গয়না খুঁজে দিলে আগে অনেক টাকা পেতেন। এখন আর আগের মতো টাকা পান না। সংসার চালাতে বেশ কষ্ট।’
বেদে সরদার আব্দুল ছাত্তার জানান, স্বর্ণ, রুপাসহ বিভিন্ন গয়না খুঁজে বেড়ানো ব্যবসা এখন মন্দা। মানুষ আর আগের মতো এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় না। তাই কেউ কেউ বিকল্প পেশার সন্ধানে ছুটছে। নিজ পেশার পরিবর্তনে খারাপ লাগে।
ডোমসার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. চাঁন মিয়া মাদবর বলেন, ‘চর ডোমসার মুন্সিরহাটের সব পুরুষ বেদেরা আগে নদী, পুকুর খাল থেকে স্বর্ণ ও রুপাসহ গয়না খুঁজে বেড়াতেন। পাশাপাশি ঝাড়ফুঁকের ব্যবসা করতেন। এখন আর এ কাজ কেউ বিশ্বাস করে না। এখন ব্যবসা বিলুপ্ত প্রায়। তাই তারা অসহায়।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি নদী পারাপারের জন্য বেদেপল্লীর শিক্ষার্থীদের একটি নৌকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সরকারের যে সাহায্য আসে তার একটি অংশ আমরা বেদেপল্লীতে দিয়ে থাকি। তাদের সচেতন করার জন্য মাঝেমধ্যেই আমরা আলোচনায় বসি। তাদের যাযাবর জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্যও সচেতন করা হচ্ছে। এছাড়া মাদকের বিষয়ে তাদের সচেতন করা হয়ে থাকে।’
সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসেবে বেদে নারী-পুরুষ যাদের বয়স ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে তাদের আমরা বয়স্কভাতা প্রদান করে থাকি। বেদে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়া হয়ে থাকে। নারীদের ৫০ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেলাইমেশিন ও শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার দিয়ে থাকি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনদীপ ঘরাই সাংবাদিককে বলেন, ‘বেদে সম্প্রদায়ের পেশা পরিবর্তনতো নিজস্ব ব্যাপার। বেদে সম্প্রদায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর যে উদ্যোগ আছে, সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। শীতে তাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গৃহহীনদের ঘর প্রদানের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। সেই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাদের যেহেতু জমি আছে ঘর নেই, তাই বেদেদের ঘর করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন