হাত উঁচিয়ে আইডি কার্ড দেখিয়ে সাংবাদিক সাংবাদিক বলে চিৎকার করেও পুলিশের গুলি থেকে বাঁচতে পারিনি

হাত উঁচিয়ে আইডি কার্ড দেখিয়ে সাংবাদিক সাংবাদিক বলে চিৎকার করেও পুলিশের গুলি থেকে বাঁচতে পারিনি

‘সেদিন রাতে আমরা কোন দিকে যাব, তা বুঝতে পারছিলাম না। কখনও বা লুকানোর চেষ্টা করছিলাম। দৌড়ানোর সময় সেখানে কোনো আন্দোলনকারী, শিক্ষার্থী বা বহিরাগত কেউ ছিল না। পেশাগত কারণে পুলিশ কর্মকর্তারা আমাদের চিনতেন, তাদের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল। আমরা হাত উঁচিয়ে আইডি কার্ড দেখিয়ে সাংবাদিক সাংবাদিক বলে চিৎকার করেছিলাম। কিন্তু তাতেও পুলিশের গুলি থেকে বাঁচতে পারিনি।’

এই কথাগুলো বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) দায়িত্ব পালনকালে গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক মেহেদী মামুন। তিনি সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আহত মেহেদী মামুন দৈনিক বর্ণিক বার্তা পত্রিকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮তম ব্যাচের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী।

১৫ জুলাই রাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় মেহেদী মামুনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন সাংবাদিক আহত হন। এছাড়াও শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। সাংবাদিক মেহেদী মামুন বলেন, ১৫ জুলাই রাত ৮টার দিকে আমাদের কাছে খবর আসতে থাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের কাছে ভিডিও আসতে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গেরুয়া, আমবাগান, ইসলামনগর এসব প্রবেশদ্বার দিয়ে বহিরাগত লোক এসে অস্ত্র মজুত করছে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি প্রক্টরকে জানাই। তবে তিনি শুধু ‘দেখছি দেখছি’ বলেই জানান। যখন আমরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুভব করি এবং আন্দোলনকারীরাও সেটা বুঝতে পারেন, তখন পুলিশ ডেইরি গেটে ও প্রান্তিক গেটে অবস্থান করছিল। এরপর পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে হাজির হন। তখন শিক্ষার্থীরা ও আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকে পড়েন।

সেখানে সংঘর্ষ হতে পারে বিধায় প্রথমে আমরা প্রো-ভিসির বাসভবনে ঢোকার চেষ্টা করি। এরপর শিল্পাচার্য ভবনের পাশে একটি জঙ্গলে আশ্রয় নিই। তখন আমরা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখে তাদের কাছে যাই। পরে কিছু পুলিশ সদস্যদের জানাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল টপকে বহিরাগতরা হামলা করছে, আপনারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। কিন্তু তারা বলে আমরা দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু পুলিশ একবারের জন্যও ফাঁকা গুলি বা টিয়ারশেল ছোঁড়েনি তখন।

রাতের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, কিছু শিক্ষার্থী এবং অছাত্রদের হাতে বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘুরতে দেখি। উপাচার্যের বাসভবনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। পরে স্বল্প সময়ের জন্য আমরা আবার প্রো-ভিসির বাসভবনের দিকে গেলাম। সেখানে আমাদের সাথে এক সহকারী পুলিশ সুপার আশ্রয় নেন। তখন আমরা কোন দিকে যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না। চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়ে গেল।

তখন আমরা আবার লুকানোর চেষ্টা করছিলাম। আমরা যখন দৌড়াচ্ছিলাম তখন কোনো আন্দোলনকারী, শিক্ষার্থী বা বহিরাগত কেউ ছিল না। পেশাগত কারণে পুলিশ কর্মকর্তারা আমাদের চিনতেন, তাদের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল। আমরা হাত উঁচিয়ে আইডি কার্ড দেখিয়ে সাংবাদিক সাংবাদিক বলে চিৎকার করেছি।

তারপরেও পুলিশ আমাকে ছররা গুলি করে, আমি মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হই এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে আমাকে সহকর্মীরা উদ্ধার করেন। মেহেদী মামুন বলেন, আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে পর্যাপ্ত আলো ছিল, কোথাও অন্ধকার ছিল না। আমরা বারবার আইডি কার্ড হাত উঁচু করে দেখিয়েছি, তাও গুলি করেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, গত ২৩ জুলাই ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মামুনের সার্জারি করা হয়েছে। তার তলপেট, বুক, কাঁধ, গলা ও ঘাড় থেকে প্রায় ২০টি ছররা গুলি বের করা হয়েছে। মামুনের অবস্থা আগের থেকে উন্নত হয়েছে। তার চিকিৎসার সকল ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহন করবে বলে জানানো হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password