ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সাইদুর রহমান স্বপনের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বর্তমান কর্মস্থল ও এর আগে পটুয়াখালীর বাউফলের উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার থাকার সময় ব্যাপক ঘুষ-বাণিজ্য, নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য, সরকারি অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম করে শূন্য থেকে রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন তিনি। দশম গ্রেডে মাত্র ১৬ হাজার টাকার স্কেলের এ পদে চাকরি করা দ্বিতীয় শ্রেণির এ কর্মকর্তা এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। বিভাগীয় শহর বরিশাল ও পটুয়াখালীতে নামে-বেনামে একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট-বাড়ি, জমিজমা ও অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। অথচ এ চাকরি করার আগে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর অজপাড়াগায়ের অতিদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান স্বপনের সম্পদ বলতে তেমন কিছুই ছিল না।
তাদের পরিবারে নূন আনতেই পান্তা ফুরাত। অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতির টাকায় কোটিপতি সাইদুর রহমান স্বপনের এ উত্থানে বিস্মিত তার এলাকার লোকজন। নলছিটি ও বাউফলের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি, এলপিআর, কল্যাণ ভাতার টাকা দিতে প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেন সাইদুর রহমান স্বপন। ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকা ডিজিটাল জালিয়াতি করে আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে স্বপনের বিরুদ্ধে। প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনের নামে বাধ্যতামূলকভাবে মোটা অঙ্কের টাকার খাম আদায় ও দামী উপহারসামগ্রী নেওয়া তার কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
শিক্ষকদের শ্রান্তি-বিনোদন ভাতা পেতেও জনপ্রতি ৫০০- ১০০০ টাকা হারে ঘুষ নেন তিনি। এছাড়া বকেয়া বিল, ঋণ পেতেও মোটা অংকের ঘুষ দিতে বাধ্য করে শিক্ষকদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক অভিযোগ করেন, মেয়ের বিয়েতে ঋণ নেওয়ার সময়ও ঘুষ দিতে হয়েছে তাকে। প্রশাসনিক কাজে তার কার্যালয়ে গেলে শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। বেশিরভাগ শিক্ষক মুখ বুজে সহ্য করেন, কেউ টাকা নেয়ার কারণ জানতে চাইলে নিজের অফিস খরচ এবং উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস ম্যানেজের কথা বলেন ওই কর্মকর্তা। শিক্ষক নিয়োগ ও সুবিধাজনক স্থানে বদলির প্রশ্ন আসলে তার পোয়াবারো, হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেন, প্রতিবছর প্রতিটি বিদ্যালয়ে আসবাব সংস্কার ও আনুষঙ্গিক খরচের জন্য ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখন এই টাকা পেতে হলে প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৬-১০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। আরেক প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেন, ‘প্রতিবছরই শিক্ষা উপকরণ কেনা ও আসবাব মেরামত করতে হয়।
এ জন্য বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগে। এমনিতেই এ খাতে বার্ষিক বরাদ্দ কম। তার ওপর বিদ্যালয়প্রতি মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছি।' অপর একজন প্রধান শিক্ষক জানান, বিদ্যালয় শিশুবান্ধব করা ও সাজসজ্জার জন্য ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতি বছরই মোটা অঙ্কের অনুদান এলেও কতিপয় অসৎ শিক্ষক নেতাদের যোগসাযজে তেমন কোনো কাজ না করে বরাদ্দের সিংহভাগ টাকাই লুটেপুটে খান সাইদুর রহমান স্বপন। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের (করেসপন্ডিং স্কেল) উন্নীত বেতনের জন্য প্রায় লাখ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ আসে। এসব অর্থ উত্তোলন করতে প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে শতকরা হারে রেখে দেন সাইদুর রহমান স্বপন। উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কার কাজের জন্য (শ্লিপের অর্থ) প্রত্যেক বিদ্যালয়ের অনুকূলে হাজার হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ আসে।
এসব অর্থ উত্তোলন করতে বিদ্যালয়প্রতি কয়েক হাজার টাকা করে ঘুষ আদায় করে স্বপন। শিক্ষকদের অভিযোগ, সাইদুর রহমান স্বপন ভ্যাট কাটার নামে ঘুষ নেন, ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষক বদলি, টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে সংযুক্তিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের একই বিদ্যালয়ে বছরের পর বছর থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। আবার অন্যদিকে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ না করেই অনেক শিক্ষককে বদলি করেছেন। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, উপজেলায় প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার্থীদের মডেল টেস্টের খাতা প্রত্যেক বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেয়ার নিয়ম থাকলেও সকল খাতা নিয়ম বহির্ভূতভাবে গোপনে বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পরীক্ষকদের জন্য সরকার থেকে সম্মানী বরাদ্ধ থাকে।
পরীক্ষার কেন্দ্রে ও খাতা মূল্যায়নের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরাদ্দকৃত সম্মানীর টাকা বিতরণের সময় প্রত্যেকের কাছ থেকে শতকরা হারে অর্থ রেখে দেন সাইদুর রহমান স্বপন। ইএফটি ফরম পূরণের নামে শিক্ষক প্রতি ৫০০-১০০০ টাকা আদায় করছেন অসৎ এ কর্মকর্তা। শিক্ষকদের ক্লাস্টার ট্রেনিংয়ের টাকা কেটে রাখা, অনুপস্থিত শিক্ষকদের ট্রেনিংয়ে উপস্থিত দেখিয়ে ভাতা ও আপ্যায়ন খরচের সরকারি অর্থ আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে সে। ভুক্তভোগী একাধিক শিক্ষক বলেন, 'পরীক্ষায় দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকদের কাছ থেকে কোন প্রকার টাকা রাখার বিধান না থাকলেও উপজেলা শিক্ষা অফিসার সাইদুর রহমান স্বপন সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে আমাদের কাছ থেকে শতকরা ১০ টাকা হারে কেটে রেখেছেন। হয়রানির ভয়ে আমরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারছি না।
একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানান, উন্নীত স্কেলের এককালীন অর্থ বরাদ্ধ আসার পর শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) সাইদুর রহমান স্বপন টাকা দাবি করেন। বাধ্য হয়ে অসৎ এ কর্মকর্তার দাবি পূরণ করেই নিজেদের প্রাপ্য টাকা উত্তোলন করতে হয় শিক্ষকদের। প্রধান শিক্ষকরা জানান, প্রতিবছর উপজেলা শিক্ষা অফিসের উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ও সরকারি নানা কার্যক্রম পালন করার জন্য সরকারিভাবে নির্দেশনা রয়েছে। একটি কার্যক্রমের জন্য সরকার প্রতি উপজেলায় ২১ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। জাতীয় এসব দিবসে বরাদ্দকৃত বেশিরভাগ অর্থ আত্মসাৎ করেন সাইদুর রহমান স্বপন। উপজেলা আন্তঃপ্রাথমিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণ করার জন্যও সরকার প্রায় সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেয়। এ টাকার বেশিরভাগই তিনি আত্মসাৎ করেন।
অভিযোগকারী শিক্ষকদের মধ্যে একজন জানান, বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে ফুল কেনার জন্য প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বরাদ্দ দুই হাজার টাকা থেকে প্রতিবার স্কুলপ্রতি ৭০০- ৮০০ টাকা করে নিজের পকেটে ঢুকান এই কর্মকর্তা। সরকারি বিধি অনুসারে কর্মস্থলে থাকার বিধান থাকলে সরকারি এ নিয়ম থোড়াই কেয়ার করছেন দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তা। তিনি নলছিটিতে না থেকে বেআইনীভাবে বরিশাল সদরের রূপাতলীতে দুর্নীতি ও ঘুষের টাকায় করা 'রিভারভিউ প্যালেস' নামের অভিজাত ভবনে বসবাস করছেন। অথচ অন্য জেলা তো দূরের কথা, কর্মস্থলের উপজেলার নির্ধারিত দূরত্বে বসবাস করার সরকারি বিধান রয়েছে। সাইদুর রহমান স্বপনের বর্তমান কর্মস্থল নলছিটি ও সাবেক কর্মস্থল বাউফলের অনেকেরই অভিযোগ, তিনি কোনো সময়ই নিয়মিত অফিসে আসতেন না।
কেবল ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম নয়, শিক্ষক ও কর্মচারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও তাদের ব্যক্তিগত নানা কাজে ব্যবহার করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে সাইদুর রহমান স্বপনের বিরুদ্ধে। শিক্ষকদের নানাভাবে হেনস্তা করলেও কোনো শিক্ষক হয়রানির ভয়ে তা প্রকাশ করেন না। শিক্ষকেরা তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন তার সম্পদ ও আয়ের উৎস খতিয়ে দেখলে তার দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসবে বলে জানিয়েছেন বাউফল ও নলছিটির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী শিক্ষকরা।
দুর্নীতিবাজ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সাইদুর রহমান স্বপনকে বরিশাল বিভাগের বাইরে বদলিপূর্বক বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন এবং সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে তার কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন অনিয়ম, দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার শিক্ষকরা। সাইদুর রহমান স্বপনের মোবাইল নম্বরে (০১৭১৬১১১৪৭৬) ফোন করলে তিনি প্রথমে এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। পরে ফ্ল্যাট-বাড়ি করার কথা স্বীকার করলেও অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ নেয়ার কথা অস্বীকার করে বিষয়টি এড়িয়ে যান। যেসব শিক্ষক অভিযোগ করেছেন কৌশলে তাদের দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন এ উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন