তিনটি মুরগি চুরির অভিযোগে শরীয়তপুরে চার ব্যক্তিকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মুরগি তিনটির বর্তমান মূল্য ৪০০ টাকা। গত ৪ এপ্রিল এ জরিমানা করা হয়। তবে ওইদিন টাকা না দেয়ায় পরে ১০ এপ্রিল আবার সালিশ বসে। শেষ সালিশে এক অভিযুক্তকে স্থানীয় মাতব্বর মতিন চৌকিদার চড় মারেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।গত ৩১ মার্চ রাতে সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নের পূর্ব সোনামুখী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের নিকটবর্তী পালং মডেল থানা ও ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম্য আদালত থাকলেও গ্রাম্য মাতব্বররা নিজেরাই বিচারের দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হয়।
অভিযুক্তরা হলেন- ওই গ্রামের ইউনুছ তালুকদারের ছেলে শাহাদাত তালুকদার (১৮), সোবাহান তালুকদারের ছেলে টিটু তালুকদার (১৯), এলাহি তালুকদারের ছেলে বাবু তালুকদার (১৮) ও আজিজ রাড়ির ছেলে জহিরুল রাড়ি (১৮)এলাকাবাসী জানান, গ্রাম্য মাতব্বর মান্নান চৌকিদার, সেকেন্দার রাড়ি, ফোরহাদ ঢালী, বোরহান মোল্লা, বোরহান সরদার, ইলিয়াস তালুকদার, গনি তালুকদার, হযরত আলী তালুকদার, আবদুল আলী মাদবর, খালেক তালুকদার, ফরিদ আহম্মদ, মতিন চৌকিদারসহ আরও বেশ কয়েকজন এ বিচারকাজ পরিচালনা করেন। এসময় সালিশ বৈঠকে অন্তত ৪০০-৫০০ লোক উপস্থিত ছিলেন।
বুধবার (১৪ এপ্রিল) সরেজমিন গিয়ে গ্রামের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৩১ মার্চ রাতে সদর উপজেলার রুদ্রকর ইউনিয়নের পূর্ব সোনামুখী গ্রামের জিল্লুর রহমান তালুকদারের ছেলে রাহাত তালুকদারের মুরগি খামার থেকে তিনটি ব্রয়লার মুরগি চুরি হয়। একই গ্রামের শাহাদাত, টিটু, বাবু ও জহিরুল এ চুরি করেছেন—এমন অভিযোগে গত ৪ এপ্রিল রাহাতের বাড়িতে সালিশি বৈঠক বসে। গ্রাম্য মাতব্বর মান্নান চৌকিদার, সেকেন্দার রাড়ি, ফোরহাদ ঢালী, বোরহান মোল্লা, বোরহান সরদার, ইলিয়াস তালুকদার, গনি তালুকদার, হযরত আলী তালুকদার, আবদুল আলী মাদবর, খালেক তালুকদার, ফরিদ আহম্মদ, মতিন চৌকিদারসহ বেশ কয়েকজন ওই চারজনকে দোষী সাব্যস্ত করে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করেন। ১০ এপ্রিলের মধ্যে মাতব্বরদের হাতে জরিমানার এ টাকা জমা দিতে বলা হয়।
কিন্তু পুরো টাকা জমা না দেয়ার পুনরায় ওইদিন বিকেলে আবার ১১০ নম্বর সোনামুখী আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সালিশি বৈঠক বসে। বৈঠকে ৪০০-৫০০ জন লোক উপস্থিত ছিল। দরবারে অভিযুক্ত শাহাদাতকে চড় মারেন স্থানীয় গ্রাম্য মাতব্বর মতিন চৌকিদার।অভিযুক্ত টিটু তালুকদার বলেন, ‘ওইদিন বিকেলে আমরা ক্রিকেট খেলি। পরে রাতে শাহাদাত, বাবু ও জহিরুল মিলে খাওয়ার জন্য তিনটি মুরগি ওই খামার থেকে আনেন। পরে আমি যুক্ত হই। সালিশে আমাদের দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।’
জানতে চাইলে স্থানীয় মাতব্বর সেকেন্দার রাড়ি বলেন, ‘মুরগি চোরদের হাতেনাতে ধরতে পারে নাই খামারের মালিক। রাতের ঘটনা, পরের দিন সকালে যেখানে মুরগি রাখছে, আনতে গিয়ে নিজেদের দোষে ধরা পড়ে যায়। যারা চুরি করছে তারা বলে তিনটা মুরগি, আর খামারের মালিক বলে ১৯৭টা। আমরা সঠিকভাবে মুরগি দেখি নাই। ওদের জবানবন্দিতে যা পাইছি...তিনজন আগেও চুরি করেছে। আর একজন নতুন যোগ করে চারজন মুরগি চোরের সঙ্গে জড়িত।’তিনি বলেন, ‘চুরি করলেতো ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। পরে জুড়িবোর্ডে বসে তাদের জরিমানা করি। জুরিবোর্ডে সভাপতিত্ব করেন খালেক তালুকদার। পেছনেও ওদের জের আছে, ওদের একটি জরিমানা করা হয়েছিল। তখন সালিশে বলা হয়েছিল, আবার এ ধরনের অপরাধ করলে ৫০ হাজার টাকা জরিমান দিয়ে পরে বিচার হবে।’
রুদ্রকর ইউনিয়ন পরিষদের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার পারুল আক্তার বলেন, ‘ঘটনার পরের দিন বিষয়টি আমি জানতে পারি। স্থানীয় রাহাত তালুকদারের মুরগি খামার থেকে ওই চারজন তিনটি ব্রয়লার মুরগি চুরি করে একটি ঝোপঝাড়ে রাখেন। রাতে একটি মুরগি শিয়ালে নিয়ে যায়। পরে আমরা ওই চারজনকে জিজ্ঞেস করি। ওরা বলে পিকনিক করবে বলে ওরা তিনটি মুরগি চুরি করেছে। স্থানীয় মাতব্বররা সালিশ-দরবার বসিয়ে দেড়লাখ টাকা জরিমানা করে।’
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুর জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান বলেন, ‘গরু চুরি হোক, আর মুরগি চুরি হোক মাতব্বরদের গ্রাম্য সালিশে এ ধরনের কোনো বিচার করা আইনি বিধান নাই। যদি প্রকৃতপক্ষে মুরগি চুরির ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে গ্রাম্য আদালত আছে। স্থানীয় চেয়ারম্যানের গ্রাম্য আদালতে আবেদন করতে পারে। সেই মোতাবেক দোষী সাব্যস্ত হলে গ্রাম্য আদালত বিচার করবে। অথবা আইনপ্রয়োগকারী তার বিচার করবে। আমি মনে করি, মুরগি চোরের বিচার করে গ্রাম্য মাতব্বররা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন।
তারা সমঅপরাধী বলে আমি বিশ্বাস করি।’জানতে চাইলে মুরগির খামার মালিক রাহাত তালুকদার কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।এ বিষয়ে শরীয়তপুরের সদরের পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আক্তার হোসেন বলেন, ‘বিষয়টা আমি জানলাম। এ ধরনের ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান সর্বোচ্চ জরিমানা করতে পারেন চার হাজার ৪৯৯ টাকা। স্থানীয় মাতব্বরদের গ্রাম্য সালিশে এ ধরনের কোনো বিচার করার আইনি বিধান নেই। আমি অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন