সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সাইদুর রহমান স্বপন চাকরি করে অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তার ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মে অতিষ্ঠ বরিশাল অঞ্চলের শিক্ষক সমাজ। ভুক্তভোগী শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারী চাকরিজীবী সাইদুর রহমান স্বপনের অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতির শাস্তি চান । দুর্নীতি দমন কমিশন তার সম্পদ ও আয়ের উৎস খতিয়ে দেখলে তার দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসবে। দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তাকে বরিশাল বিভাগের বাইরে বদলিপূর্বক বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন এবং সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে তার কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন অনিয়ম, দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার শিক্ষকরা। দুর্নীতির দায়ে আটক করারও দাবি জানিয়েছেন বরিশাল অঞ্চলের ভুক্তভোগী শিক্ষকসমাজ।
সাইদুর রহমান স্বপনের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকে বিভিন্ন সময়ে নিউজ প্রকাশিত হলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের (করেসপন্ডিং স্কেল) উন্নীত বেতনের জন্য প্রায় লাখ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ আসে। এসব অর্থ উত্তোলন করতে প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে শতকরা হারে রেখে দেন সাইদুর রহমান স্বপন। বিদ্যালয় শিশুবান্ধব করা ও সাজসজ্জার জন্য ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতি বছরই মোটা অঙ্কের অনুদান এলেও কতিপয় অসৎ শিক্ষক নেতাদের যোগসাযজে তেমন কোনো কাজ না করে বরাদ্দের সিংহভাগ টাকাই লুটেপুটে খান সাইদুর রহমান স্বপন।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি, এলপিআর, কল্যাণ ভাতার টাকা দিতে প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেন সাইদুর রহমান স্বপন। ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকা ডিজিটাল জালিয়াতি করে আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে স্বপনের বিরুদ্ধে। প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনের নামে বাধ্যতামূলকভাবে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় ও দামী উপহারসামগ্রী নেওয়া তার কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। শিক্ষকদের শ্রান্তি-বিনোদন ভাতা পেতেও জনপ্রতি ৫০০-১০০০ টাকা হারে ঘুষ নেন তিনি। ভুক্তভোগী এক শিক্ষক বলেন, 'বকেয়া বিল, ঋণ পেতেও মোটা অংকের ঘুষ দিতে বাধ্য করে শিক্ষকদের। হয়রানির ভয়ে আমরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারছি না।'
পটুয়াখালীর বাউফল ও ঝালকাঠির নলছিটির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, সাইদুর রহমান স্বপন দশম গ্রেডে মাত্র ১৬ হাজার টাকার স্কেলের উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার পদে চাকরি করে অবৈধভাবে এখন অঢেল সম্পদের মালিক। অথচ এ স্কেল কার্যকর হয়েছে ২০১৬ সালে, এর আগে তার বেতন ছিল অর্ধেকের কম। বিভাগীয় শহর বরিশাল ও পটুয়াখালীতে নামে-বেনামে একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট-বাড়ি, জমিজমা ও অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। অথচ এ চাকরি করার আগে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর চরের অতিদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান স্বপনের সম্পদ বলতে তেমন কিছুই ছিল না।
অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতির টাকায় অঢেল সম্পদের মালিক সাইদুর রহমান স্বপনের এ উত্থানে বিস্মিত তার এলাকা ও কর্মস্থলের লোকজন। উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কার কাজের জন্য (শ্লিপের অর্থ) প্রত্যেক বিদ্যালয়ের অনুকূলে হাজার হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ আসে। এসব অর্থ উত্তোলন করতে বিদ্যালয়প্রতি কয়েক হাজার টাকা করে ঘুষ আদায় করে স্বপন। এক প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেন, প্রতিবছর প্রতিটি বিদ্যালয়ে আসবাব সংস্কার ও আনুষঙ্গিক খরচের জন্য ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখন এই টাকা পেতে হলে প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৬-১০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। আরেক প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেন, ‘প্রতিবছরই শিক্ষা উপকরণ কেনা ও আসবাব মেরামত করতে হয়। এ জন্য বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগে।
এমনিতেই এ খাতে বার্ষিক বরাদ্দ কম। তার ওপর বিদ্যালয়প্রতি মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছি।' নলছিটি ও বাউফলের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা জানান, শিক্ষকেরা তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। প্রতিবছর উপজেলা শিক্ষা অফিসের উদ্যোগে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ও সরকারি নানা কার্যক্রম পালন করার জন্য সরকারিভাবে নির্দেশনা রয়েছে। একটি কার্যক্রমের জন্য সরকার প্রতি উপজেলায় ২১ হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
জাতীয় এসব দিবসে বরাদ্দকৃত বেশিরভাগ অর্থ আত্মসাৎ করেন সাইদুর রহমান স্বপন। উপজেলা আন্তঃপ্রাথমিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণ করার জন্যও সরকার প্রায় সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেয়। এ টাকার বেশিরভাগই তিনি আত্মসাৎ করেন। দুর্নীতিবাজ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা স্বপন যেখানেই যান, সেখানেই সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি করেন। নলছিটি ও বাউফলের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষক বদলি, টাকার বিনিময়ে শিক্ষকদের অবৈধভাবে একই বিদ্যালয়ে বছরের পর বছর থাকার সুযোগ করে দেওয়া, উন্নীত স্কেলের এককালীন অর্থ বরাদ্ধ আসার পর টাকা দাবি, ভ্যাট কাটার নামে ঘুষ আদায়, ইএফটি ফরম পূরণের নামে শিক্ষক প্রতি ৫০০-১০০০ টাকা আদায়, শিক্ষকদের ক্লাস্টার ট্রেনিংয়ের টাকা কেটে রাখা, অনুপস্থিত শিক্ষকদের ট্রেনিংয়ে উপস্থিত দেখিয়ে ভাতা ও আপ্যায়ন খরচের সরকারি অর্থ আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে সাইদুর রহমান স্বপন।
নলছিটিতে না থেকে বেআইনীভাবে বরিশাল সদরের রূপাতলীতে দুর্নীতি ও ঘুষের টাকায় করা 'রিভারভিউ প্যালেস' নামের অভিজাত ভবনে বসবাস করছেন স্বপন। অথচ অন্য জেলা তো দূরের কথা, কর্মস্থলের উপজেলার নির্ধারিত দূরত্বে বসবাস করার সরকারি বিধান রয়েছে। সাইদুর রহমান স্বপনের বর্তমান কর্মস্থল নলছিটি ও সাবেক কর্মস্থল বাউফলের অনেকেরই অভিযোগ, তিনি কোনো সময়ই নিয়মিত অফিসে আসতেন না। কর্মস্থলে থাকার বিধান থাকলে সরকারি এ নিয়ম থোড়াই কেয়ার করছেন দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তা। সে কেবল ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম নয়; শিক্ষক ও কর্মচারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, নারী শিক্ষকদের নিয়ে নোংরা মন্তব্য ও তাদের ব্যক্তিগত নানা কাজে ব্যবহার করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে সাইদুর রহমান স্বপনের বিরুদ্ধে।
দুর্নীতিবাজ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সাইদুর রহমান স্বপনের মোবাইল নম্বরে (০১৭১৬১১১৪৭৬) ফোন করলে তিনি প্রথমে এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। পরে ফ্ল্যাট-বাড়ি করার কথা স্বীকার করলেও অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ নেয়ার কথা অস্বীকার করে বিষয়টি এড়িয়ে যান। যেসব শিক্ষক অভিযোগ করেছেন তাদের দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন এ উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা। সামান্য বেতনে চাকরি করে এত সম্পদ কিভাবে করলেন, এ বিষয়ে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন