রাজধানীর তুরাগ এলাকায় ছোট্ট দুই রুমের টিনশেড বাসায় ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন গার্মেন্টকর্মী ফরহাদ হোসেন। ভাড়া দেন ৬ হাজার ৫০০ টাকা। পরিবারের তিন জন উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মধ্যে তার দুই ছেলের চাকরি নেই ছয় মাস হলো। করোনার কারণে বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা যে সোয়েটার কারখানায় কাজ করতেন সেটিও এখন বন্ধ। এখন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি নিজেই। তার আয়েই কোনোমতে চলছে সংসার। এ অবস্থায় দফায় দফায় চাল, ডাল, তেলসহ সব নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে সংসার চালাবেন কীভাবে?—এ চিন্তা এখন তার কাছে রীতিমতো ‘আতঙ্কে’ পরিণত হয়েছে বলে জানান তিনি। ফরহাদ হোসেনের মতো স্বল্প আয়ের মানুষদের এখন এমনই অবস্থা। আর এর মধ্যেই চলতি সপ্তাহে শুরু হচ্ছে রমজান।
সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গতকাল শুক্রবার তাদের খুচরা বাজারদরের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গতকাল বাজারে সয়াবিন তেলের দাম আরেক দফা বেড়েছে। বেড়েছে আদার দামও। এ দুটি পণ্য ছাড়াও গত এক সপ্তাহের মধ্যে চাল, ময়দা, মসুর ডাল ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বলেও সরকারের এ সংস্থাটি জানিয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কাওরান বাজার, তুরাগ এলাকার নতুন বাজার ও শান্তিনগর বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম তিন টাকা বেড়ে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের খুচরা বাজার মূল্য ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। খোলা সয়াবিনের পাশাপাশি দাম বেড়েছে বোতলজাত সয়াবিন তেলেরও। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৩০ থেকে ৬৫০ টাকায়। আর এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১০৮ থেকে ১১০ টাকায়। আর পাম সুপার তেল বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১২ টাকা দরে।
এদিকে আর এক মাস পর পুরোদমে বোরো কাটা শুরু হবে। কিন্তু তার আগেই বাজারে আরেক দফা বেড়েছে চালের দাম। এক সপ্তাহ আগেও খুচরাবাজারে মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা পাওয়া যেত ৪৬ থেকে ৪৮ টাকার মধ্যে। কিন্তু তা এখন কেজিতে দুই থেকে চার টাকা বেড়ে ৪৮ থেকে ৫২ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে সরু চালের দামও। কেজিতে দুই টাকা বেড়ে এক সপ্তাহের ব্যাবধানে নাজিরশাইল/মিনিকেট এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। আর মাঝারি মানের চাল পাইজাম/লতা বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৬০ টাকায়। যা চার দিন আগেও কেজিতে দুই টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।
এদিকে সপ্তাহের ব্যাবধানে এক লাফে মাঝারি দানা মসুর ডালের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। আর ছোট দানা মসুর ডালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ ওঠায় অনেক দিন বাজারে পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু এখন রমজানকে উপলক্ষ্য করে এই পণ্যটির দামও বেড়েছে। তিন-চার দিনের ব্যাবধানে কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। আর কেজিতে তিন টাকা বেড়ে আমদানিকৃত পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়।
আদার দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। দেশি ও আমদানিকৃত দুই ধরনেরই আদার দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি দেশি আদা ৮০ থেকে ১২০ টাকা ও আমদানিকৃত আদা ৮০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এছাড়া গত দুই সপ্তাহের মধ্যে বেড়েছে চিনি, ময়দা ও অ্যাংকর ডালের দাম। প্রতি কেজি চিনির দাম তিন টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায়। খোলা ময়দার দাম কেজিতে দুই টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৩৮ টাকায়। প্যাকেট ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। আর অ্যাংকর ডাল কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়।
স্বল্প আয়ের মানুষ যে সবজির ওপর বেশি নির্ভরশীল তার দামও এখন বাড়তির দিকে। এক-দেড় মাস আগেও ২০ থেকে ৪০ টাকা কেজির মধ্যে প্রায় সব ধরনের সবজি পাওয়া গেলেও এখন ৪০ টাকা কেজির নিচে সবজি নেই বললেই চলে। কোনো কোনো সবজির দাম ৬০ টাকায় উঠে গেছে। আর এক মাসের ব্যাবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায়।
টিসিবির হিসেবে গত এক সপ্তাহের মধ্যে দাম বেড়েছে মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, পাইজাম/লতা ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ, মসুর ডাল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজ ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, দেশি আদা ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। এদিকে লাগামহীনভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। বিশেষ করে করোনার কারণে কাজ হারানো শ্রমজীবী মানুষরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।
সম্প্রতি নাগরিক প্ল্যাটফরম, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘কীভাবে অতিমারিকে মোকাবিলা করছে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী : একটি খানা জরিপের ফলাফল’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন জানানো হয়, করোনার অতিমারির প্রভাবে সাধারণ মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। আয় কমে যাওয়ায় দেশের দরিদ্র ৮০ ভাগ পরিবার তাদের নিত্যদিনের খাবার খরচ কমিয়ে ব্যয়ের সমন্বয় করছেন। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ৬০ শতাংশ পরিবার।
এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ক্যাব) সহ-সভাপতি নাজির হোসেইন গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে নিত্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এ ব্যাপারে আমরা বারবার কঠোরভাবে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য সরকারকে বলেছি। কিন্তু সরকার এটা করছে না। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টিসিবি স্বল্প মূল্যে কিছু নিত্যপণ্য বিক্রি করছে। এতে শ্রমজীবী মানুষ কিছুটা হলেও উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু টিসিবির লাইনে তো মধ্যবিত্তরা দাঁড়াতে পারছে না। তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোরভাবে বাজার মনিটরিংয়ের বিকল্প দেখছি না।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন