বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায়। পেশায় মসলা বিক্রেতা। ঝড়-বৃষ্টি রোদ আর প্রচন্ড শীতে মাথায় নিয়ে মসলার বস্তা আজ এ গ্রাম তো কাল আর এক গ্রাম। গ্রাম ঘুরলেই নিবারণ হয় পেটের ক্ষুধা। গোলা বারুদের মুখে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া প্রতাপ চন্দ্রের কাছে ঝড়-বৃষ্টি রোদ এখন যেন কিছুই নয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বদলে গেছে সব কিছু কিন্ত একটুকুও বদলায়নি স্বীকৃতি না পাওয়া প্রতাপ চন্দ্রের জীবন। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষেও প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে নিজের সাথে। স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষাদ কষ্ট হারিয়ে গেছে বস্তা ভর্তি মসলার স্বাদে।
আর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায় হলেন উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের কাজীরচওড়া গ্রামের মৃত তাড়িনীকান্ত রায়ের ছেলে। অসুস্থ্য স্ত্রী বিমালা রানীকে নিয়ে একটি একচালা টিনের ঘরে তার বসবাস। ঘরটি মেরামত করার সামর্থ্যও নেই তার। যা আয় হয় তার বেশীর ভাগ টাকায় খরচ হয় স্ত্রীর চিকিৎসা জন্য। অবশিষ্ট টাকা দিয় দু’এক বেলা খেয়ে, না খেয়ে দিনানিপাত করেন তারা।
জানা গেছে, মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ৭১'র ১৮ বছরের যুবক প্রতাপ চন্দ্র রায়। গোলা বারুদের মুখে নিজের জীবন বাজি রেখে বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ সমরে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশকে শত্রু মুক্ত করেন তিনি। যুদ্ধ শেষে নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। তিনি একজন সরকারি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম রয়েছে সরকারি তালিকায়। যার নম্বর-২০৫৯৪৪। প্রতাপ চন্দ্র যুদ্ধে গিয়েও স্বীকৃতি না পেলেও তারই নাম ও তালিকা নাম্বর ব্যবহার করে দীর্ঘদিন থেকে সব কিছুই ভোগ করে আসছেন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার প্রতাপ চন্দ্র নামে আর এক ব্যাক্তি। গত ২০১৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা যাছাই বাছাই কমিটির মাধ্যমে মসলা বিক্রেতা মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায়ের কাগজপত্র সঠিক প্রমাণিত হয়। আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহৃত হন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার প্রতাপ চন্দ্র। ফলে গঙ্গাচড়া উপজেলার প্রতাপ চন্দ্রের সরকারি ভাতা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এরপরেও স্বীকৃতি পাননি লালমনিরহাটের মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র।
সকল সুবিধা বঞ্চিত বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায়ের (৬৮) সাথে কথা হলে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘১৮ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। যুদ্ধ করেছি। মাতৃভমিকে শত্রুমুক্ত করেছি। কিন্তু আমার জীবনের সংগ্রাম এখনো থামেনি। প্রতিটি মুহুর্ত সংগ্রাম করেই বেঁচে আছি।’
গ্রামে গ্রামে গিয়ে মসলা ফেরি করে বেড়ান বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায়
কান্না থামিয়ে অশ্রু সিক্ত চোখে অপলক তাকিয়ে থেকে আবারও কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আমি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুড়ে ঘুড়ে হকারি করি। সে কারণে মুক্তিযোদ্ধার তালিকার কোনও খোঁজখবর রাখতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার সকল ধরনের কাগজপত্র রয়েছে। কিন্তু গঙ্গাচড়ার প্রতাপ চন্দ্র প্রতারণা করে আমার নাম তালিকা নম্বর ব্যবহার করে সরকারি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন। এটি প্রমাণিত হলেও আজো স্বীকৃতি পাইনি আমি।’
এ বিষয়ে লালমনিরহাট সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘মসলা বিক্রেতা মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায়ের সকল কাগজপত্র যাছাইবাছাই শেষে সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে এর ফলাফল চলে আসবে। অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সকল ধরনের সরকারি সুযোগসুবিধা পাবেন। আর রংপুরে গঙ্গাচড়া এলাকার অপর প্রতাপ চন্দ্রের সরকারি ভাতা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে। বিধি মোতাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ঠ দপ্তর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন