স্বামী থেকেও নেই ২৩ বছর বয়সী তানিয়া আক্তারের। বছর দুয়েক আগে তাকে ফেলে চলে যান স্বামী মো. আব্দুল। এরপর স্বামীর বাড়ি থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। তখন তানিয়ার কোলে সদ্যজাত সন্তান। মাথায় যেন বাজ পড়ে তার। নিজের নিরাপত্তা আর সন্তানের ভরণ-পোষণের কথা ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি।
তবে ভেঙে পড়েননি। নিজের আর সন্তানের জন্য দুই বেলা দুমুঠো খাবার যোগাতে পান-সিগারেট কিনে ফেরি করে বিক্রি করতে শুরু করেন তানিয়া। দিনভর সন্তানকে কোলে নিয়ে নগরীতে ঘুরে ঘুরে পান-সিগারেট বিক্রির পর রাতে ঘুমাতেন একটি যাত্রী ছাউনিতে। তবে দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়েনি।
মাস তিনেক আগে একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার পান-সিগারেটের বাক্সটি চুরি হয়ে গেছে। এরপর নিরুপায় হয়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেন তানিয়া আক্তার। এই অবস্থাকেই নিয়তি ভেবে যখন পথচলা শুরু করলেন, তখন তার পাশে দাঁড়াল বরিশাল জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করে তাকে একটি ফ্লাস্ক, চা পাতা, চিনি, পান-সুপারিসহ বিভিন্ন উপকরণ কিনে দেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) দুপুরে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে তানিয়া আক্তারের হাতে এসব উপকরণ তুলে দেন জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রাজিব আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) প্রশান্ত কুমার দাস ও সমাজ সেবা অধিদফতরের জেলা প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজ সহ অন্যান্যরা।
ফ্লাস্ক, চা পাতা, চিনি, পান-সুপারিসহ বিভিন্ন উপকরণ পেয়ে খুশিতে আপ্লুত তানিয়া আক্তার।
তিনি বলেন, ‘মানুষের সামনে হাত পেতে টাকা নেয়াটা কত যে লজ্জার, বলে বোঝানো যাবে না। ডিসি স্যারের কল্যাণে সহায়তা পেয়েছি। এখন আর দুই বছরের মেয়ে জান্নাতকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করা লাগবে না। শুধু তাই নয়, ডিসি স্যার থাকার জন্য একটি ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আল্লাহ তার অনেক ভাল করুক। দোয়া করি।’
তানিয়া আক্তার বরগুনার আমতলী উপজেলার উলাতলা গ্রামের জাফর প্যাদার মেয়ে। ৪ বছর আগে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর এলাকার দীন মোহাম্মদের ছেলে মো. আব্দুলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আব্দুল পেশায় একজন রং মিস্ত্রি।
তানিয়া আক্তার জানান, চার বছর আগে তার বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছর পর তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়। সংসার জীবনে সুখের কমতি ছিল না। কন্যা সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছিল তাদের। কিন্তু হঠাৎ করে সব এলোমেলো হয়ে গেল। বিয়ের দুই বছরের মাথায় জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। তার মা রাবেয়া বেগম দ্বিতীয় বিয়ে করেন। অন্য কাউকে নয়, রাবেয়া বিয়ে করেন তার (তানিয়া) শ্বশুর দ্বীন মোহাম্মদকে। লোকলজ্জার ভয়ে তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।
তবে আত্মহত্যা মহাপাপ আর সদ্যজাত সন্তানের কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত সে পথ থেকে ফিরে আসেন। তাতে অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। ভেঙে যায় তানিয়ার সংসার। ওই ঘটনার পর স্বামী মো. আব্দুল তাকে ছেড়ে চলে যান। এরপর শুরু হয় সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। একটি কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধর্না দিয়েছেন। তবে সন্তান ছোট দেখে তাকে কেউ কাজে নেননি।
বছরখানেক আগে কাজের খোঁজে মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে বরিশাল নগরীতে আসেন। এরপর পান সিগারেট কিনে নগরী লঞ্চঘাট, বঙ্গবন্ধু উদ্যান, কেডিসি সহ বিভিন্ন স্থানে ফেরী করে বিক্রি শুরু করেন। রাতে থকতেন থাকতেন লঞ্চঘাট সংলগ্ন চরকাউয়া খেয়াঘাট এলাকায় একটি যাত্রী ছাউনির নিচে। এভাবেই চলছিলো সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই।
গত ২৩ মার্চ নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যান পরিদর্শনে গেলে সেখানে সন্তানকে কোলে নিয়ে তানিয়া আক্তারকে ভিক্ষা করতে দেখতে পান জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার। ভিক্ষাবৃত্তির কারণ শুনে তাকে সহায়তার আশ্বাস দেন ডিসি।
এ বিষয়ে সমাজ সেবা অধিদফতরের জেলা প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, ‘তানিয়া আক্তারের জীবন সংগ্রামের বর্ণনা শুনে জেলা প্রশাসক স্যার আমাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে বলেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, স্বামী, আত্মীয়-স্বজন কেউ তানিয়ার খবর নেন না। পান সিগারেট বিক্রি করে সামন্য টাকা দিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে কোনোভাবে বেচে ছিল সে। মাস তিনেক আগে তানিয়ার পান সিগারেট সহ বাক্সটি চুরি হয়ে যায়। এরপর থেকে তানিয়া আক্তার ভিক্ষা করছেন।’
জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ‘জীবনযুদ্ধে স্রোতের প্রতিকূলে চলার কঠিনতম লড়াই করে যাচ্ছেন তানিয়া আক্তার। জীবনে যত বিপদই আসুক, হতাশ হতে নাই। চেষ্টা করলেই টিকে থাকা যায়। তানিয়া আক্তার তার বড় উদাহরণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তানিয়ার মতো নারীরা একটু সহায়তা পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। আর তারা অন্যের মুখাপেক্ষী না থেকে স্বাবলম্বী হবে। আর তাহলেই বাংলাদেশ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।’
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন