পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয়ের কম্পিউটার ডেটা অপারেটর পদে চাকরি করতেন লাকি রানী পাল (৩০)। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে প্রতিদিনের মতো গতকাল রবিবার রাতের রান্না করছিলেন। একপর্যায়ে লাকির গায়ে আগুন লেগে যায়। ওই সময় পাশের কক্ষে ভাইদের সঙ্গে তাস খেলায় মগ্ন স্বামী তাঁর চিৎকার শুনতে পাননি। সোমবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজার থানা এলাকার সেনগ্রামের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।
লাকিকে পরে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে রাতেই তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।লাকির পরিবার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করা হলেও হয়তো তাঁকে বাঁচানো যেতো।তবে লাকির স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দাবি, লাকি রান্নাঘরে একাই রান্না করছিলেন। চুলার পাশে কুপি থেকে তাঁর কাপড়ে আগুন লেগে যায়। ঘটনাটি দুর্ঘটনাবশত ঘটেছে।
লাকির পরিবারের ক্ষোভ প্রকাশের কারণে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠায় পুলিশ। বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে লাকির মরদেহ পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়।এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, বাড়িটিতে রান্নাঘরের পাশের কক্ষে তাস খেলছিলেন স্বামী ও তাঁর ভাইয়েরা। তাঁরা খেলায় মগ্ন থাকায় কোনো চিৎকার শুনতে পাননি। এর পাশের কক্ষে শ্বশুর ছিলেন। তিনি চিৎকার শুনে কক্ষ থেকে বের হয়ে লাকিকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় দেখতে পেয়ে ছেলেদের খবর দেন।
লাকির বাবা প্রদীপ পাল ও লাকির সহকর্মীরা জানান, প্রায় তিন বছর আগে পারিবারিকভাবে লাকির বিয়ে হয়েছিল হিমাদ্রি পালের সঙ্গে। হিমাদ্রি পাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তাঁদের দেড় বছরের একটি ছেলে সন্তানও রয়েছে। প্রতি মাসে বেতনের পুরো টাকা স্বামী-শ্বশুরের কাছে দিয়ে দিতেন লাকি। নিজের খরচের টাকা তাঁদের কাছ থেকে চেয়ে নিতে হতো। এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য চলছিল। তবে সন্তানের কথা চিন্তা করে অনেকটা নিশ্চুপ ছিলেন লাকি। পরিবারের ঝামেলার কথা সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। কিছুদিন আগে যাতায়াতের টাকা না থাকায় এক সহকর্মীর কাছ থেকে ধার নিয়েছিলে লাকি। চলতি মাসের বেতনের টাকা শ্বশুরবাড়ি ও স্বামীকে দেবেন না বলেও সহকর্মীদের জানিয়েছিলেন। এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বিরোধ চলছিল তাঁর।
লাকির বাবা প্রদীপ পাল বলেন, ‘রাতে আমার বেয়াই আমাকে ফোন করে জানান, আমার মেয়ে আগুনে দগ্ধ হয়েছে। আমাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে গিয়ে ভর্তির টিকিট নিতে বলেন। আমি গিয়ে টিকিট নেওয়ার পর রাত নয়টার দিকে তাঁরা হাসপাতালে আসে। এ সময় আমার মেয়ে আর্তনাদ করছিল। সে কী বলছিল, আমি কিছুই বঝুতে পারিনি। পরে তাঁর স্বামীর পরিবার আমাকে জানায়, রান্না করতে গিয়ে কুপির আগুনে দগ্ধ হয়েছে।’
লাকির বাবা বলেন, ‘কুপির আগুন থেকে শরীরের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ার বিষয়টি সন্দেহজনক। আমার মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে কী হচ্ছে বিষয়গুলো আমাকে বলত না। তবে তার বোন ও সহকর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি তাদের মুখ থেকে ঘটনাগুলো শুনছি। ঘটনার পর লাকির স্বামী হাসপাতালেও আসেনি। মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পরও আসেনি। এ ব্যাপারে থানায় অবহিত করা হয়েছে। অভিযোগের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছি।’
শ্বশুর হলধর চন্দ্রপাল ও দেবর হিমেল পাল বলেন, ‘আমরা দেখিনি কীভাবে আগুন লেগেছে। তাঁর চিৎকার শোনার পর আমরা এগিয়ে গিয়ে দেখি, কাপড়ে আগুন লেগে গেছে। এ সময় আমরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছি। পরে উদ্ধার করে হাসপাতালে এনেছি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে।’
লাকির শ্বশুর ও দেবর জানান, ঘটনার পর থেকে লাকির স্বামী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ জন্য হাসপাতালে যাননি।
সিলেট মহানগর পুলিশের মোগলাবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ছাহাবুল ইসলাম বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে ঘটনার খবর শুনে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠাই। এ ছাড়া মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন ওঠায়, মারা যাওয়া নারীর লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। হত্যার অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করে দেখা হবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন