বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত এক প্রস্তাবে অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসিরুদ্দিন এলানের কারাদণ্ডের নিন্দা জানিয়ে তাদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিশেষ করে অধিকারের মামলা’ শীর্ষক ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এছাড়া এই প্রস্তাবে মানবাধিকার ছাড়াও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রসঙ্গ এসেছে এবং অবাধ বাজার সুবিধা (ইবিএ) বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রাখা যৌক্তিক কী-না সেই প্রশ্নও তুলেছেন।
এ সুবিধার অংশ হিসেবে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশের পণ্য। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এর বড় সুবিধাভোগী। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট (ইবিএ) নিয়ে এমন সময় প্রশ্ন তুললো যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাংলাদেশের এই বাজার সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়ে আলোচনা চলছে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিষয়টি বাংলাদেশ সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে বা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে ইউরোপীয় কমিশন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার দিকে অগ্রসর হলে সেটি বাংলাদেশের জন্য আশঙ্কার কারণ হতে পারে।
--প্রস্তাবে যা আছে--
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী সাতটি পার্লামেন্টারি গ্রুপ ‘অধিকার ও বাংলাদেশের মানবাধিকার ইস্যু’তে প্রস্তাবটি তুলেছিলেন। আট জন সদস্য প্রস্তাবটি নিয়ে সেখানে আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে ছয় জন প্রস্তাবের পক্ষে ও দু'জন বিপক্ষে কথা বলেছেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের জন্য ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) সুবিধা আরও বর্ধিত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এমন অবস্থায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা বলেন, অধিকারের সঙ্গে হওয়া এ বিষয়টি দুঃখজনকভাবে একটি পশ্চাদগামী পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ইইউ পার্লামেন্ট সদস্যরা। এই ইবিএ বা অবাধ বাজার সুবিধাই মূলত জিএসপি বা অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা। এ সুবিধার কারণেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রায় ষাট ভাগই ইউরোপের বাজারে যেতে পারছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। কিন্তু ওই বছর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটনার কথা। তবে ২০২৬ সালে এটি হলেও পরবর্তী তিন বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা রয়েছে।
তবে সুবিধাটি পেতে হলে বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে বাংলাদেশকে, যা নিয়ে ইউরোপীয় কমিশনের সঙ্গে এখন আলোচনা চলমান রয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনে চলার আহবান জানানো হয়।
একইসঙ্গে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকারকর্মী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাজের নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয় ওই প্রস্তাবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্য রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের কথাও এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, বিচার বহির্ভূত হত্যা, বলপূর্বক নিখোঁজ বা গুম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করাসহ বাংলাদেশে নানাভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। বলপূর্বক নিখোঁজ বা গুমের অভিযোগ তদন্তে একটি বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে ওই প্রস্তাবে।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আদালতের শুনানিতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়ার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরতে ইউরোপীয় এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিস, ইইউ প্রতিনিধি ও বাংলাদেশে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দূতাবাসকে অনুরোধ জানিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।
--শক্ত ভাষা ব্যবহার হয়েছে--
মানবাধিকার, গণতন্ত্র বা সুশাসনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরই সোচ্চার। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে পশ্চিমা কূটনীতিকরা যে তৎপরতা দেখাচ্ছেন তাতে ইইউ প্রতিনিধিরাও সক্রিয় আছে।
এবার 'অধিকার' – এর মামলার রায় হওয়ার পরপরই ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আলোচনা ও প্রস্তাব পাশ হওয়াকে অনেকে বিশেষ গুরুত্ববাহী বলে মনে করছেন। বিশেষ করে অধিকার-এর বিচার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অবাধ বাজার সুবিধা বা ইবিএস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো কেন- তা নিয়ে কথা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে।
ব্রাসেলসে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এ এইচ এম মনিরুজ্জামান বলছেন মানবাধিকার বা গণতন্ত্র ইস্যুতে তাদের কথা বলা নতুন না হলেও এবারের রেজুলেশনটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এতে বেশ কিছু বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। হয়তো এমন রেজুলেশন সামনে আরও আসতে পারে।
“এবার তাদের বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে তারা প্রস্তাবে একটু শক্ত ভাষা ব্যবহার করেছেন। এখানে তারা সতর্কবার্তা দিয়েছে। জিএসপি (ইবিএ) ইস্যুতে ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। পরবর্তীতে এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রেজুলেশনও হয়তো আসতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে তাদের সম্পর্কসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে,” মি. মনিরুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন। তবে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবগুলো সাধারণত ইউরোপীয় কমিশনে যায়।
যে কোন বিষয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত কমিশনই নিয়ে থাকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন যে মানবাধিকার বা গণতন্ত্র ইস্যুতে ইউরোপীয় কমিশন বা পার্লামেন্টের এমন অবস্থান নতুন না হলেও এবারের প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়েছে যে প্রেক্ষাপটে এসেছে সেটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
তার মতে প্রেক্ষাপটটি হলো- জিএসপি প্লাসের বিষয়ে ইউরোপীয় কমিশনের সাথে বাংলাদেশের আলোচনা চলছে এবং আরও কয়েক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা।
“ঠিক এ মূহুর্তে জিএসপি নিয়ে তারা যে ইঙ্গিত দিয়েছে সেটিকে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ তাদের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অনুকূলে না হলে তো আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকে। এছাড়া তারা সবসময়ই মনে করে মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো ঠিক না থাকলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও ঠিক থাকে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. কবির।
--ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া--
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এ ধরণের প্রস্তাবে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে একে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে 'অপপ্রচার ও চক্রান্ত হিসেবে' উল্লেখ করেছে। “বাংলাদেশ সরকার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবের বিষয়বস্তুর সাথে একমত নয়,” পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ বলছেন যে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেনি, বরং সেখানে ‘বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর মতো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে’। “ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার প্রতিফলনও এই প্রস্তাবে হয়নি। অনেকটা রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো ঢালাও কিছু কথা এসেছে সেখানে।
সেখানকার বিএনপি নেতারা ইতোমধ্যেই বলেছেন যে তারাই এর উদ্যোক্তা। তাই এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি। তবে এসব কথার সাথে পুরোপুরি একমত নন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ডঃ শাম্মী আহমেদ।
তার মতে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষ লবিস্ট গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করে নানা জায়গায় এ ধরণের আলোচনার আয়োজন করে মূলত তাদের স্বপক্ষে রাজনৈতিক বক্তব্য আনার জন্য। “এখানেও তাই হয়েছে এবং প্রস্তাবটিতে রাজনৈতিক বক্তব্যই এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ধরণের প্রস্তাবের বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
সূত্রঃ বিবিসি
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন