আজ মঙ্গলবার, ১৪ জুন। বাংলা একাডেমির সভাপতি ও কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ৭৬তম জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের এই দিনে রাজশাহী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রামে। বাবার নাম এ কে মোশাররফ হোসেন এবং মায়ের নাম মরিয়মন্নেসা বকুল। সাত ভাইবোনের মধ্যে সেলিনা হোসেন হচ্ছেন চতুর্থ।
জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন রচনা করেছেন কালোত্তীর্ণ নানা লেখা। হয়েছেন বিভিন্ন ভাষার পাঠকের কাছেও অতি প্রিয়। তাঁর গল্প-উপন্যাসে আধুনিকতার ছাপ প্রবলভাবে ধরা দিয়েছে। আধুনিকতার এই হাতেখড়িও শুরু হয় পরিবার থেকেই। আকিকা করা ‘খায়রুন্নেসা’ নাম বদলিয়ে তার বড় বোন পরীক্ষার খাতায় নাম রাখেন ‘সেলিনা হোসেন’। সময়ের তুলনায় যা নিঃসন্দেহে প্রবল সাহসিকতা, একই সঙ্গে আধুনিকতা। ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। রাকসু এবং ছাত্রী হলে নির্বাচনও করেন আধুনিক এই কথাকার। তাঁর মা ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, যা তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোতে ধরা পড়ে। ১৯৪৭ সালে ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্ম বাংলা ভাষার প্রভাবসঞ্চারী লেখক সেলিনা হোসেনের। ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই প্রকাশ পায় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনে প্রবেশ ঘটলেও মধ্য ষাটের দশকে গল্পচর্চা শুরু করেন সেলিনা হোসেন। তিনি মনে করেন, “লেখক তার সাহিত্যে রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ এবং দেশজ প্রকৃতির মধ্যে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন, সে শেকড় যায় গভীর থেকে গভীরে। কথাসাহিত্যে সেই শেকড় প্রোথিত করা সহজ। ছড়ানো ছিটানো বর্ণনা, অসংখ্য চরিত্র মিলে এই ক্যানভাস হয়ে ওঠে অনেক বড়। যা কবিতায় সহজ নয়।” লেখালেখিই তাঁর একমাত্র আরাধ্য। লেখালেখি তাকে দিয়েছেও প্রচুর। ইংরেজি, রুশ, কানাডিসহ নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গল্প-উপন্যাস। দেশ-বিদেশের বেশ কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর রচনা পাঠ্য। শিলচরের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি উপন্যাস এমফিল গবেষণাভুক্ত। সেলিনা হোসেনের সাহিত্যকর্মের ওপর হয়েছে ১১টি পিএইচডি। বাবার চাকরির কল্যাণে তিনি দেখেছেন বাংলার প্রকৃতি। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মানুষের জীবন, যা সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। তিনি অতীতকে দেখেন বর্তমানের দৃষ্টিতে। খুঁজে নেন শিল্পিত উপাদান, যা তার ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে উপস্থিতি। লোভ, অধঃপতন ও প্রতিরোধের এই গল্পে টের পাওয়া যায় স্বৈরশাসনের বিপক্ষে তাঁর অবস্থান। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সেলিনা হোসেনের লেখার মৌল উপাদান। তিন খণ্ডে প্রকাশিত ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সালের ধারা বর্ণনা পাই সহজেই।
সেলিনা হোসেনের সাহিত্যের মূল প্রবণতা সময়কে নিজস্ব ঘরানায় চিহ্নিত করা। যার কারণে ঘুরেফিরে রাজনীতি নানাভাবে তাঁর লেখায় ধরা দেয়। একসময়ের তুমুল আলোচিত ছিটমহল নিয়ে লেখেন ‘ভূমি ও কুসুম’ উপন্যাস। সম্ভবত বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম এই বিষয়ে উপন্যাস লিখেন। সেই সময়, অধ্যাপক উইলিয়াম ভ্যান সেন্ডেলের (নেদারল্যান্ডস) একটি গবেষণা পড়ে আন্দোলিত হন সেলিনা হোসেন। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের পটভূমি লেখা ‘ভূমি ও কুসুম’-এ মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে তাৎপর্যপূর্ণ। নানা বিষয়ে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতেই বেশি ভালোবাসেন সেলিনা হোসেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পরবর্তীকলে ওই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ। কাল্পনিক এক কাহিনির শেষে এসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কঠিন বাস্তবতা তুলে আনেন উপন্যাসের শেষ অংশে। বুড়ি তার ছেলেকে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তুলে দেওয়ার এ ঘটনা লেখক জানেন তার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল হাফিজের কাছ থেকে। যশোরের কালীগঞ্জের এই ঘটনা নিয়ে গল্প লিখতে প্রথমে অনুরোধ তিনিই করেন। “তুই মরে গেলি। আমি রইলাম তোর শোক বহন করার জন্য।” মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করা সন্তানের জন্য সব মায়ের করুণ হাহাকার বুড়ির মাধ্যমেই ধরা দিয়েছে।
২০০৫ সাল থেকে শিকাগোর ওকটন কলেজের সাহিত্য বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য কোর্সে উপন্যাসটি পাঠ্য। সেলিনা হোসেন মানুষকে দেখেছেন নানাভাবে। নাগরিক মধ্যবিত্তের আত্মসংকট, ধর্মান্ধতা বিষয়কে নিয়ে রচিত হয়েছে তার নগরজীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস ‘মগ্ন চৈতন্যে শিষ’। ১৯৭৩ সালে প্রকাশ পায় তার প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’ প্রকাশ পায়। নদী তীরবর্তী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষের সংগ্রামী জীবনধারাকে চিত্রিত করেছেন এখানে। একইভাবে নাফ নদীর তীরবর্তী মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চিহ্নিত হয়েছে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’তে। এশিয়া ও আফ্রিকা এই দুই মহাদেশের মানুষের গল্প নিয়ে রচনা করেন ‘গাছটির ছায়া নেই’। ২০১২ সালে এইচআইভি ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। সেলিনা হোসেনের অনুপ্রেরণার এক বড় অংশজুড়ে বিচরণ করছে কবিগুরুর জীবন ও সাহিত্য সৃষ্টি। বিশ্বকবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়েও রয়েছে সেলিনা হোসেনের সরব উপস্থিতি। শিলাইদহ, পতিসর, শাহবাজপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থানের পটভূমি নিয়ে চিত্রিত হয়েছে ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’।
রবি ঠাকুরের ছোটগল্পের চরিত্রগুলোকে ভেঙে নতুন করে, ‘ছিন্নপত্র’ ও নাটক ব্যবহার করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে। উপমহাদেশের শক্তিশালী কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে রচিত হয়েছে নানান ধরনের বই। দেশ-বিদেশের অসংখ্য গবেষকদের বিষয় হয়েছেন তিনি। তাঁর জীবন নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এই মানুষকে নিয়ে সেলিনা হোসেন ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’র তুলে এনেছেন শিল্পের সঙ্গে ইতিহাসের যোগ। সেলিনা হোসেনের লেখার বিষয়-বৈচিত্র্যে অনন্য। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, উঠে এসেছে মানবিকতা। মা-মেয়ের গভীর সম্পর্কের সফল উদাহরণ তার ‘লারা’ উপন্যাস। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার অদূরে পোস্তগোলায় এয়ার পারাবতের সেসাস-১৫০ প্রকৃতির বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন লেখকের প্রিয় কন্যা, দেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক বৈমানিক ফারিয়া লারা। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে লারা লেখেন, ‘আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি পৃথিবীতে। আমরা হয়তো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।’ ফারিয়া লারার দৈহিক প্রস্থান হলেও তার স্বপ্ন এখনো জাগিয়ে রেখেছে মা সেলিনা হোসেন এবং বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান। লারা গণমানুষের কথা ভাবত।
তার ভাবনা আর স্মৃতি আঁকড়ে ওই একই বছর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘লারা ফাউন্ডেশন।’ “দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার প্রান্তিক নারী-মেয়ে-শিশু ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বেকার সমস্যা নিরসনে সর্বাত্মক সহায়তা দান”—এই লক্ষ্যে দুই দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনটি। ফারিয়া লারার এই মৃত্যুতে প্রচণ্ড ভেঙেও পড়েছিলেন সেলিনা হোসেন। স্তব্ধ হয়ে যায় তার কলম। দেহ-মনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অস্থির অবস্থায়ও হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়ে ফিরে আসেন আবার। লেখেন নিয়মিত। শুধু উপন্যাস নয় গল্প, শিশুসাহিত্যেও রয়েছে তাঁর সরব উপস্থিতি। মননশীল প্রবন্ধেও জয় করেছেন পাঠকহৃদয়। তাঁর সাহিত্যকর্মে উঠে এসেছে দেশ, সমাজ আর মানুষের কথা। যেখানে খুব সহজেই ধরা পড়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজের আলো কিংবা অন্ধকার।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন