ফজল হাঁটছে আর চারদিকে দুই চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। অনেক পরিবর্তন। সেই ছনের ছাউনির মাটির ঘরের জায়গায় এখন বিল্ডিং হয়েছে। বাড়ি যেন ঝকঝকে, চকচকে করছে। পুকুর ঘাটও এখন অনেক ছিমছাম, পরিপাটি। ফজলের মনে হচ্ছে সবকিছু যেন আভিজাত্যের মোড়কে বাধা। ২০ বছর আগে মাসহ পিতৃহীন ছোট পাঁচ ভাই-বোন রেখে ৩০ বছরের ফজল যখন বাড়ি ছেড়েছিল, সেদিন পুকুর ঘাট পর্যন্ত অশ্রুসিক্ত নয়নে মা এসেছিলেন বিদায় জানাতে।
সেটাই মায়ের সঙ্গে ফজলের শেষ দেখা। ২০ বছরের প্রবাস জীবনে একবারের জন্যও দেশে আসা সম্ভব হয়নি। ফজল প্রবাসী হওয়ার পরেই যেন বাড়ির সবার চাহিদা, প্রয়োজন অনেক বেড়ে গিয়েছিল। মা অনেকবার চিঠি দিয়েছেন, ফোন ধরে কান্নাকাটি করেছেন—‘বাবা একবার এসে আমাকে দেখে যা’। কিন্তু ফজল আসবে কীভাবে? যে টাকা রোজগার করত, সেটা দেশে পাঠানো আর থাকা-খাওয়ার খরচের পর অবশিষ্ট কিছুই থাকত না। তাই টিকিটের টাকাটাই কখনো জমাতে পারেনি।
ফজল ছাড়া অন্য ভাই-বোনেরা সংসারী হয়েছে, সবাই যার যার মতো করে ব্যস্ত জীবন কাটাচ্ছে। মেজ ভাইয়ের বড় ব্যবসা, এলাকার চেয়ারম্যানও। ভালোই রোজগার, সেই সঙ্গে প্রভাব প্রতিপত্তি। ছোট ভাইটাও একটা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিন বোনের স্বামীরাও যার যার মতো করে প্রতিষ্ঠিত। সবাই নিজেদের সন্তান, সংসার নিয়ে সুখেই আছে।
ফজল ধীর গতিতে হাঁটে। সবকিছু দেখে আর মনে মনে বলে ‘আমার কষ্ট সার্থক হয়েছে।’ হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো সেই কদম গাছের নিচে এসে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সেই কদম গাছ এখনো আগের মতোই আছে। অনেক স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কদম গাছটা। হঠাৎ রেশমার কথা মনে পড়ে তার। ঠিক এখানেই, এই কদম গাছের নিচেই রেশমা তার হাত ধরে বলেছিল ‘ফজল ভাই, আমাকে এভাবে রেখে যেওনা। বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দেবে।
রেশমা এসব বলছিল আর কাঁদছিল। কিন্তু ফজলের দায়িত্ববোধের কাছে তখন প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে এগুলো ছিল মূল্যহীন। মায়ের কষ্ট গোছাতে হবে, ভাইদের মানুষের মতো মানুষ করতে হবে, বোনদের উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার মতো অবস্থা তখন ফজলের ছিল না। কদম গাছটার নিচে এসে তাই রেশমার কথা খুব মনে পড়ছে আজ। ছোট ভাইয়ের কাছে শুনেছে, অবস্থা সম্পন্ন ঘরে ওর বিয়ে হয়েছে। স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই আছে।
হাঁটতে হাঁটতে দিঘির পাড়ে চলে এসেছে ফজল। হঠাৎ নিজের নাম শুনে পেছনে ফিরে দেখল, মুখে হাসি নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে আছে তার বাল্যবন্ধু রহমত। ফজলের মতো এত ভেঙে পড়েনি, এখনো ফিটফাট। বয়স পঞ্চাশের ঘরে, সেটা বোঝার উপায় নেই।
‘কেমন আছিস দোস্ত?’—ফজলের কাঁধে হাত রেখে রহমত জানতে চায়। এক টানে রহমতকে বুকে টেনে নিয়ে ফজল বলে, ‘ভালো আছি দোস্ত, খুব ভালো আছি।’ দুজনের চোখ দিয়েই অশ্রু ঝরছে, কত দিন পর দেখা। ‘মাঝে মাঝে চিঠি দিয়েও তো আমাদের খোঁজ নিতে পারতি।’—আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠ রহমত জিজ্ঞেস করে। ফজলের যেন কিছুই বলার নেই, সবকিছুই এখন দীর্ঘশ্বাস। ‘বাড়ির সব খবর জানিস তো?’—রহমত জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যাঁ, সব খবর জানি, সবাই ভালো আছে।’ এবার রহমত একটু মুচকি হেসে বলল, ‘বন্ধু তুই এখনো আগের মতোই সহজ সরল আর নিঃস্বার্থ রয়ে গেলি।
—কেন বন্ধু, কী হয়েছে?
—তোদের জায়গা সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছে, সেটা কি তুই জানিস?
—ভাগ বাঁটোয়ারা, কীসের ভাগ বাঁটোয়ারা?
ফজল যেন কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করল। রহমত ফজলকে নিয়ে দিঘির পাড়ে নিরিবিলি জায়গায় বসে পড়ল।
—আমি তোদের বাড়ির সব খবরই পাই বন্ধু। রহমত বলতে শুরু করে। ফজলের বিদেশ যাওয়ার পরে মায়ের মৃত্যু থেকে শুরু করে ভাই বোনদের বিয়ে, সম্পত্তির বাঁটোয়ারা সবকিছুই রহমত ফজলকে জানায়। ফজল রহমতের কথা শুনছে আর এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে প্রবাসের সেই কঠিন দিনগুলোর কথা।
মেজো ভাই একবার চিঠি দিল—‘ভাইজান, আমি নতুন ব্যবসা শুরু করব, ৫০ হাজার টাকার দরকার।’ এই খবর পেয়ে অনেক কষ্টে ধার করে ফজল টাকা পাঠিয়েছিল। এই দেনা শোধ করার জন্য ১২ ঘণ্টার রেগুলার কাজের পরেও প্রায় এক বছর দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘণ্টা করে তাকে আরও একটা কাজ করতে হয়েছিল। ছোট ভাইয়ের জন্য প্রত্যেক মাসে আলাদা করে খরচ পাঠাত।
মায়ের চিকিৎসা, বোনদের বিয়েসহ বিভিন্ন বাবদে নিয়মিত টাকা পাঠাতে গিয়ে দেনার জাল থেকে বেরিয়ে আসা ফজলের পক্ষে ছিল অসম্ভব। যে কারণে এ ২০ বছরে দেশে আসা সম্ভব হয়নি তার।
শরীরের শক্তি আর আগের মতো নেই, শরীরে এখন বিভিন্ন রোগের বাসা। কোম্পানি তার ভিসার মেয়াদ আর বাড়াতে রাজি হয়নি। কিন্তু ফজলের তো জমা কিছুই নেই, দেশে যাওয়ার টিকিট কাটবে কীভাবে? এ ক্ষেত্রে কোম্পানি তাকে নিরাশ করেনি, এত দিনের বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে কোম্পানি তার দেশে ফেরার টিকিটের টাকা দিয়েছিল। তাই পুরোপুরি শূন্য হাতে দেশে ফেরা। তবে মনটা আনন্দিত আর গর্বিত ছিল এই ভেবে যে, নিজের জীবনের জমা খাতা শূন্য হলেও, ভাই-বোনেরা সবাই যার যার মতো করে ভালো আছে।
‘কী ভাবছিস ফজল?’—রহমতের কথায় ফজলের যেন সংবিৎ ফিরে এল। ‘না, কিছু না দোস্ত। এখন বাড়ি যাব, তুইও চল আমার সঙ্গে।’
—আমি আসলে তোকে দেখার জন্য এসেছিলাম। যাই হোক দেখা হয়ে গেছে, এখন আর ঘরে যাব না। অন্য একদিন আসব।
এভাবে রহমত ফজলের কাছে বিদায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। ফজলও আর জোর না করে ঘরের দিকে পা বাড়াল। গর্বিত আনন্দিত বুকটা যেন হঠাৎ করে এক ঝোড়ো তুফানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। মনের মধ্যে প্রবাহিত প্রচণ্ড ঝড়-তুফানে ফজল নির্ঘুম একটা রাত শেষ করল। সকালে বারান্দায় বসে চা হাতে ভাইদের ডেকে নিয়ে ফজল জানতে চায়—‘আজ আমি তোমাদের কাছে কিছু কথা জিজ্ঞেস করব, আশা করি সঠিক উত্তর আমাকে জানাবে।’ বড় ভাইয়ের এ রকম কথা বলার ধরনে ছোট দুই ভাই কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল।
ছোট ভাইয়ের উৎসুক জিজ্ঞাসা, জি ভাইজান, বলেন কী জানতে চান?
—‘আমি সহজ সরল মানুষ, সহজ ভাবেই কথা বলতে পছন্দ করি। আমাদের বাড়ি নাকি ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে।’ ভাইদের দিকে তাকিয়ে ফজল জানতে চাইল। প্রথম আলো
ভাইয়েরা সবাই ইতস্তত করছে। এর মধ্যে মেজ ভাইয়ের বউ বলতে শুধু করল, হ্যাঁ, ভাইজান। বাড়ির ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে। দুই ভাই আর তিন বোনে যার যার প্রাপ্য বুঝে নিয়েছে।
মেজ বউয়ের কথাগুলো যেন ফজলের কানে বজ্রের মতো আঘাত করছে। কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে ভাইদের কাছে জানতে চায়—দুই ভাই আর তিন বোন, এটার মানে কী? আমরা তো তিন ভাই-তিন বোন।
এবার ছোট বউয়ের জবাব, ভাইজান আপনার কথা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি তো অনেক বছর নিরুদ্দেশ, নিখোঁজ।
নিরুদ্দেশ, নিখোঁজ শব্দ দুটি যেন তীরের মতো ফজলের বুকে লাগছে। নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট দুই ভাইকে উদ্দেশ্য করে সে বলে, ঠিক আছে আমি নিরুদ্দেশ ছিলাম, এখন তো ফিরে এসেছি। তাহলে তোমরা সবাই মিলে আমার পাওনাটা ফিরিয়ে দাও। ফজল জানে এগুলো তার মনের কথা নয়, ভাইদের একটু পরখ করে নিতে চাইছে। এখন আর এসব জায়গা সম্পত্তি দিয়ে কী হবে। ভাইদের সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলেই ও সুখী। তাদের সুখ আনন্দই তো তার সুখ-আনন্দ।
মনে পড়ে, বাবা মারা যাওয়ার পর মা একদিন ফজলের হাত ধরে বলেছিলেন, ‘বাবা, তুমি আমার বড় ছেলে। তোমাদের বাবা বেঁচে নেই। তাই ছোট ছোট ভাই-বোনের দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।’ মায়ের সেই কথাগুলো আর মায়াভরা মুখটি ফজলের সামনে ভেসে উঠছে। ভেতরটা গুমরে উঠল। মনে মনে মাকে বলে, ‘মা, একবার এসে দেখে যাও আমি আমার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পেরেছি কিনা? মনে হয় পারিনি, তাইতো আজ ভাইয়েরা আমাকে পর করে দিচ্ছে।’
মেজ বউ কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বলল, ‘এসব কী বলছেন ভাইজান। আপনি তো এখন বুড়ো হয়ে গেছেন, আর কয়দিনই বা বাঁচবেন। এ ছাড়া বিয়ে করেননি, বাচ্চা নেই, আপনি জায়গা সম্পত্তি দিয়ে কী করবেন?’ মেজ বউয়ের কথায় কান না দিয়ে ফজল ভাইদের মুখের দিকে থাকিয়ে আছে।
যদি তারা চিৎকার করে বলে, তুমি থামো, এসব বলার সাহস তুমি কোথায় পেলে, তিনি আমাদের বড় ভাই। আমাদের জন্য নিজের জীবনটা শেষ করে ফেলেছেন, পারলে নিজেদের কলিজাটা দিয়ে দেব, ক্ষমা চাও ভাইজানের কাছে। না, ভাইয়েরা তেমন কিছুই বলেনি। বরং মেজ বউয়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে লাগল, ‘মেজ বউ তো ঠিকই বলছে। আপনার তো বয়স হয়েছে, সংসারও করেননি, এসব দিয়ে কী করবেন?’
ফজল আর কথা বাড়ায় না, নিজের ভালোবাসার মায়া মমতার পৃথিবীটা যে আজ ভেঙে গেছে। তীব্র ভূমিকম্পে যেন ভেতরটা প্রকম্পিত।
পরদিন থেকেই সংসারের সবার আচার-আচরণ ফজলের কাছে অন্যরকম মনে হচ্ছে। সকালে কেউ চা নিয়ে আসেনি, খাবারের বেলা পেরিয়ে যাচ্ছে কেউ তাকে ডাকছে না। প্রতিদিন সকালের খাবার সবাই মিলে এক সঙ্গে খায়। আজকে আর সেটা হয়নি। বাড়ির কাজের লোকটা ফজলের ঘরে খাবার রেখে বলে গিয়েছে, ‘ভাইজান, খাবার দেওয়া হয়েছে, খেয়ে নিয়েন।’ এভাবেই কাটল আরও কয়েক দিন। ফজলের মনে হচ্ছে সংসারে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সে যেন একটা আগাছা, ভাইদের সংসারে নিজেকে একটা আবর্জনার মতোই মনে হচ্ছে।
ফজলের মনে হচ্ছে, আজ শরীরের অনুভূতি একটু অন্যরকম। অন্য দিনের থেকে আলাদা। সারা শরীর যেন অবশ লাগছে। মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিছানা ছেড়ে পুকুরের দিকে পা বাড়াল। পুকুরের ও পাড়েই তাদের পারিবারিক কবরস্থান। মা-বাবার জন্য মনটা হঠাৎ যেন কী রকম এক অজানা টানে শিহরণ দিচ্ছে।
আস্তে আস্তে ফজল কবরস্থানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাবা-মায়ের কবর পাশাপাশি। বাবার কবরের ওপর থেকে এক টুকরো মাটি নিয়ে চুমু দিয়ে আস্তে আস্তে মায়ের কবরের পাশে বসে পড়ল। মা যেন তার সামনে বসে আছেন। দুই হাত দিয়ে কবরটাকে জড়িয়ে ধরেছে। ‘মা, ও মা, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ। আমার ভেতরের অবস্থাটা দেখছ?’ দুই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে কবরের ওপর। এত দিনের বোবা কান্নাগুলো আজ বৃষ্টি ধারায় ঝরছে। ভেতরের জমে থাকা
পাথরগুলো যেন গলে গলে চোখ দিয়ে ঝরছে। ফজল হাউমাউ করে ওঠে—‘মা, ও মা, এ জীবনে আমি কী পেলাম গো মা। কোনো দিন নিজের জন্য কিছু চিন্তা করিনি, ভালো খাইনি, পরিনি.... শুধুই দেশের কথা, ভাই-বোনদের কথা চিন্তা করেছি, আজ তো তাদের সবকিছু আছে, আমার কী আছে মা? জীবনের সব স্বাদ আহ্লাদ, সুখ, প্রেম ভালোবাসা বিসর্জনের বিনিময়ে আমি কী পেলাম?’
ফজল কোনো দিন এ রকম কাঁদেনি, কান্না যেন থামতেই চাচ্ছে না। সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমেছে। ফজল ধীরে ধীরে উঠে হাঁটা শুরু করল, না আর বাড়ি যাওয়া যাবে না। এত দিন যখন একা চলতে পেরেছে এখনো পারবে। সবাই শুধু নিজের কথাই ভাবে, সেও এখন থেকে নিজের কথাই শুধু ভাববে। আল্লাহর এত বড় দুনিয়াতে কোথাও না কোথাও তার একটু আশ্রয় হবেই। ভালোবাসার কাঙাল ফজল তাই হাঁটতে শুরু করে অজানার পথে। অন্যরকম ভালোবাসা, নিজের জন্য ভালোবাসার খোঁজে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন