সামিরা ও তার ডিম ভাজি

সামিরা ও তার ডিম ভাজি

শ্বশুরবাড়ি ৭ কেজি মিষ্টি আর ৩ কেজি রসমলাই নিয়ে যাওয়ার পর রাতে আমায় খেতে দিলো ৯৫টাকা কেজি দরের পাঙ্গাশ মাছের দুই টুকরো ভাজি আর ১২০টাকা কেজি দরের পোল্ট্রি মুরগীর আলু দিয়ে রান্না করা পাতলা ঝোলের তরকারি
খাবার গুলো দেখে আমি আমার স্ত্রী সামিরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললামঃ 
কোন সস্তা জাতীয় খাবার নেই? এত দামী খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না

সামিরা চোখের কোণে জমে থাকা জলটা মুছে বললোঃ
বিয়ে করার সময় মনে ছিলো না বাপ-মা মরা মেয়েকে বিয়ে করলে শ্বশুরবাড়ির আদর জুটবে না? ভাইয়ের সংসারে থেকে বড় হয়েছি। এতটুকু যে পাচ্ছো এটাই অনেক।

সামিরা কথা শুনে আমি আর কিছু বললাম না। বাটি থেকে তরকারি যখন প্লেটে নিবো তখন সামিরা আমায় বাঁধা দিয়ে বললোঃ
যে জিনিসটা খেতে পারো না সেটা এখন খেয়ে আমায় খুশি করতে হবে না। একটু বসো আমি ডিম ভেজে নিয়ে আসছি
সামিরা ডিম ভাজতে গেলে ওর ভাবী বললোঃ
ডিম ভাজি করছো কেন? রান্না কি ভালো হয় নি?
সামিরা তখন মাথা নিচু করে বললো,
আসলে ভাবী ওর পাঙ্গাশ আর পোল্ট্রিতে এলার্জি।
ভাবী তখন খোঁচা দিয়ে বললোঃ
বড়লোক জামাই তো, তাই গরীবের খাবার মুখে উঠে না।

সামিরা কথাটা শুনেও না শুনার অভিনয় করে ও ওর কাজ করতে লাগলো আর আমি কথাটা হাসিমুখে চুপচাপ হজম করলাম।

পরের দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙলো ৯টার দিকে। ঘুম থেকে উঠে দেখি সামিরা সমানে পুরো বাসা পায়চারি করছে। আমি তখন দুষ্টামি করে সামিরাকে বললামঃ
তোমার পেটে কি গ্যাসের সমস্যা দেখা দিয়েছে? ঠিকঠাক মত বাথরুম হচ্ছে না বলে এইভাবে সমানে হাটছো?

সামিরা মুখটা গোমড়া করে বললোঃ
তুমি যাও ফ্রেস হয়ে আসো।

আমি জানি সামিরা কেন এমন করছে
সামিরার ডাকা ডাকিতে ওর ভাই ভাবী ঘুম থেকে উঠে দরজা খুললো সাড়ে দশটার দিকে। ওর ভাই তখন বললোঃ
কিরে, ছুটিরদিনে এত সকালে ডাকছিস যে?

সামিরা তখন বললোঃ
ভাইয়া সাড়েদশটা বেজে গেছে তোমাদের জামাইকে এখনো নাস্তা দেওয়া হয়নি। ডাকছিলাম ফ্রিজের চাবিটা দিতে। নাস্তার জন্য ফ্রিজ থেকে ডিম আর সবজিগুলো নিতাম আর কি।

পিছন থেকে সামিরার ভাবী তখন বললোঃ 
আর বলো না, ফ্রিজ লক করে রাখি তোমার ভাইয়ার জন্য। তোমার ভাইয়ার ডায়বেটিস তারপরও ফ্রিজ খুলে শুধু মিষ্টি খায়। এজন্যই লক করে রাখি

সামিরা তখন বললোঃ
ভাবী, রাতে আমি যখন ডিম নিলাম তখনও ফ্রিজটা লক করা ছিলো না। আর ভাইয়ার ডায়বেটিস নেই।

সামিরার ভাই তখন আমতা-আমতা করে বললোঃ
তোর ভাবী ঠিক বলছে রে। আমার আজকাল ডায়বেটিস দেখা দিয়েছে। 

সকালের নাস্তা দিতে দিতে বেজে গেলো ১১ঃ৩০। আমি নাস্তার টেবিলে বসে সামিরাকে আস্তে করে বললামঃ
কি দরকার ছিলো নাস্তা বানানো? আরেকটু পর না হয় দুপুরের খাবারটাই একেবারে খেয়ে নিতাম।

আমার কথা শুনে সামিরা যখন রাগী চোখে আমার দিকে তাকালো তখন আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ নাস্তা করে নিলাম।

ভেবেছিলাম নাস্তার পর আরাম করে একটু ঘুম দিবো তার আগেই সামিরা এসে বললোঃ 
অনেক হয়েছে শ্বশুরবাড়ি থাকা। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও এখনি বাসায় যাবো।

আমি অবাক হয়ে বললামঃ 
গতকাল বিকালে আসলাম আর আজকেই চলে যাবো? আমি তো ভেবেছিলাম কয়েকদিন শ্বশুরবাড়ি থাকবো। 

সামিরা রেগে গিয়ে বললোঃ 
তোমার কিসের শ্বশুর বাড়ি? তোমার শ্বশুরও বেঁচে নেই শ্বাশুড়িও বেঁচে নেই। তাই তোমার কোন শ্বশুড়বাড়িও নেই।

সামিরা রাগে কথাগুলো বলছিলো আর ওর দুইগাল বেয়ে অনবরত জল পড়ছিলো। মেয়েরা খুব অদ্ভুত হয়। নিজের বাড়িতে স্বামীর চুল পরিমাণ অযত্ন সহ্য করতে পারে না।

চাচাতো ভাইয়ের বিয়েতে যখন আমি মা আর সামিরা গেলাম তখন চাচী মাকে ডেকে বললোঃ
আপা, ফকিন্নির বাড়িতে আমার ছেলেকে বিয়ে কারাই নি। মেয়ের বাড়ির লোকজন আমার ছেলেকে ফ্রিজ টিভি মোটরসাইকেল সবি দিয়েছে। তা আপনার ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে ছেলেকে কি দিলো?

মা হেসে বললোঃ
নিজের বাড়ির মেয়েকে দিয়েছে। আর কি দিবে?
চাচী বললোঃ
ফ্রিজ, টিভি, মোটরসাইকেল কিছু দেয় নি?
মা তখন বললোঃ
আমার ঘরে দুইটা ফ্রিজ আছে একটা নরমাল ফ্রিজ আরেকটা ডিপ ফ্রিজ তাই আরেকটা ফ্রিজের কোন দরকার নেই। ৪২ ইঞ্চি একটা এলইডি টিভি আছে তাই টিভিরও দরকার নেই। ছেলের আমার প্রাইভেট কার আছে, তাই মটরসাইকেলের দরকার নেই। 

আমার ঘরে আল্লাহ রহমতে সব আছে কিন্তু ছিলো না একটা মেয়ে। ওরা আমায় মেয়ে দিয়েছে তাই আমার আর কিছু চাই না।

মার কথা শুনে চাচী কিছু না বলে সামনে থেকে চলে গেলো আর সামিরা তখন কেঁদে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলছিলো।

মা তখন সামিরাকে বললোঃ
এই তোর সমস্যা কি? কিছু হলেই এমন করে কাঁদিস কেন? এত সুন্দর করে সেজেছিলি আর এখন কেঁদে সব নষ্ট করলি। শোন মা, ১৬ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়েছিলো। এই ছোট বয়সে চুপচাপ সংসারের জন্য দিনরাত কেটেও কোন সম্মান পেতাম না। শ্বাশুড়ি, ননদ, দেবর সবার শুধু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতো। একসময় বুঝলাম আমার চুপ থাকাটাই আমাকে কথা শুনানোর কারণ। তারপর থেকে আর চুপ থাকি নি। সবার দোষগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি।
 
একটা কথা মনে রাখবি, যখনি তোর উপর অন্যায় হবে তখনি প্রতিবাদ করবি। যদি চুপচাপ থেকে সহ্য করতে যাস, তাহলে কিন্তু এই চোখের জল ফেলতে হবে।

সামিরার ভাই ভাবী আমাদের বাসায় আসবে আর এটা শুনে সামিরা আমার হাতে লম্বা একটা বাজারের লিষ্ট ধরিয়ে দিলো। এটা দেখে আমি মাকে ডেকে বললামঃ
মা, আমি তো ভেবেছিলাম ১ কেজি ওজনের পাঙ্গাশ আর দেড়কেজি ওজনের একটা পোল্ট্রি মুরগী আনবো কিন্তু তোমার বউমা যে লিষ্ট দিলো তাতে তো দেখছি পুরো বাজার মাথায় করে তুলে আনতে হবে।

আমার কথা শুনে মা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললঃ
সব সময় বউয়ের পিছনে লাগিস কেন? যা তো সামনে থেকে। যা আনতে বলেছে সেগুলো নিয়ে আয়।

৩ পদের গোশতের সাথে ৪ পদের মাছের তরকারি সেদিন রান্না করেছিলো সামিরা ওর ভাই ভাবীর জন্য। ভাবী যখন খাচ্ছিলো তখন আমি উনার কানের কাছে আস্তে করে মুচকি হেসে বললামঃ
বড়লোক জামাইয়ের বড়লোকি খাবার গলা নিয়ে নামছে তো?

খাওয়া দাওয়া শেষে ড্রয়িংরুমে সবাই যখন বসে ছিলাম তখন সামিরার ভাই সামিরাকে বললোঃ
আসলে আমি এসেছিলাম একটা দরকারে। তোর স্বামীর তো অনেক আছে। আর আমার অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। আমি চাইছিলাম তোর নামে মা যে জমিটা লিখেদিয়েছিলো সেটা বিক্রি করে ব্যবসার কাজে লাগাতে। তুই এই জমিটার দামী ছেড়ে দে।

সামিরা তখন বললোঃ
আমি কেন দাবী ছাড়বো? আর এই দাবী আছে বলেই বাপের বাড়ি গিয়ে আমার জামাই আর আমি পাঙ্গাসের ভাজি আর পোল্ট্রি মুরগীর ঝোল দিয়ে চারটা ভাত খেতে পারি। এখন যদি দাবী ছেড়ে দেই তাহলে তুমি আর তোমার বউ আমাকে আর আমার স্বামীকে ফকির মিসকিন ভেবে তাড়িয়ে দিবে। 
তোমার অবস্থা এতটাও খারাপ হয় নি যে তোমার ছোট বোনের জামাই গেলে একবেলা ভালো কিছু খাওয়াতে পারবে না। আমার জামাই তো আর প্রতিদিন তোমার বাসায় বসে থাকে না।

সামিরা এইবার ওর ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললোঃ
আমার ভাই যখন তোমাদের বাড়ি যায় তখন কি তুমি ভাইয়াকে সকাল ৮টার নাস্তা দুপুর ১২টায় দাও নাকি? আর আমি এতটাও ছোটলোক না যে তোমাদের আড়ালে ফ্রিজ থেকে কিছু নিয়ে আমার স্বামীকে খাওয়াবো।

আমি আমার ভাগ ছাড়বো না। যখন সময় হবে তখন ঠিকিই আমি আমার ভাগ বুঝে নিবো।

সামিরার কথা শুনে ওর ভাই ভাবী আর কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেলো।

'পাথর মারলে পাথর, ইট মারলে ইট, ঠিকই ফিরে আসে,


উজ্জল রাজ
সম্পাদক
বিডি টাইপ নিউজ।

মন্তব্যসমূহ (০)


Lost Password