বাংলা নাটকের শিকড় সন্ধানী
নাট্যকার সেলিম আল দীন। তাকে বাংলা নাটকের গৌড়জন বলা হয়। নাট্যাচার্য হিসেবেও সমধিক
পরিচিত। বাংলার মাটিতে, বাংলার জল হাওয়ায়, বাংলার প্রাণের ভাষাতেই জন্ম নেয়া তার নাটকগুলো
বাংলা নাটকের সব উপাদানকে আধুনিকের মন নিয়ে ছুঁয়ে যায়। এ কারণেই বাঙালির কাছে সেলিম
আল দীন এক অবিস্মৃত নাম। নাটক রচনায় ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের রচনারীতি এবং পরিবেশনাশৈলীর
নতুন রূপ নির্মাণের মাধ্যমে নাটক লিখেছেন তিনি
বরেণ্য নাট্যকার সেলিম আল দীন জন্মেছিলেন ১৯৪৯ সালের ১৮ই আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখীল গ্রামে। বাবা মফিজউদ্দিন আহমেদ ও মা ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান তিনি ৷ শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে বাবার চাকরির সূত্রে এসব জায়গার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন তিনি। সেলিম আল দীন ১৯৬৪ সালে ফেনীর সেনেরখীলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ১৯৬৬ সালে ফেনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করোটিয়ায় সাদত কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মধ্যযুগের বাঙলা নাট্যের উপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
স্কুলছাত্র থাকাবস্থায়
সেলিম আল দীন বাংলাসাহিত্যের প্রধান প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের রচনা পড়ে ফেলেন। তখন থেকেই
একটু একটু করে তৈরি হতে থাকে একজন সৃজনশীল শিল্পীর মনন। কলেজে ওঠার সময়টায় বুঝতে পারেন
কবিতা তাকে ডাকছে। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে
বিমুগ্ধ তরুণ সেলিম আল দীন কবিতার মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করতে চাইলেন প্রথমে। কিন্তু
কিছুতেই কবিতার ভাষাটি আয়ত্তে আসছিল না তার। এই বেদনা তাকে তাড়িয়ে ফেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র থাকার সময়েও। সাহিত্যের কোন শাখাকে পথচলার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেবেন, এই টানাপোড়েনের
মধ্যেই তার নাটক লেখা শুরু। সহপাঠী বন্ধুদের চাপে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল
নাট্য প্রতিযোগিতার জন্য প্রথম নাটক লেখেন। তারপরথেকে নাটকই হয়ে ওঠে তার পথ চলার প্রধান
বাহন।
১৯৭৩ সালে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর নাটক লেখার ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সেলিম
আল দীন নিজস্ব এক নাট্যরীতির অনুসন্ধান চালিয়ে যান। প্রসেনিয়ামের গন্ডিতে বাঁধা ইউরোপিয়ন
নাট্য-আঙ্গিককে তিনি পরিত্যাগ করে খুঁজে বের করলেন বাংলা নাটকের হাজার বছরের পুরনো
শিল্পরীতিকে। এ নাট্যরীতি আমাদের একেবারেই নিজস্ব। ছোটগল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধের মতো
পাশ্চাত্যের প্রেরণাতাড়িত বিষয় নয়। লুঙ্গিনুসের ‘অন সাবলাইম’ আর পিটার ব্র“কের ‘দ্য
এম্পটি স্পেস’-এর মতো তত্ত্বগুলোর সঙ্গে তিনি সমন্বয় করতে চাইলেন প্রাচ্যের নান্দনিকতার।
ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের নির্যাস ও বাংলা ভাষার মধ্যযুগের সাহিত্যরীতি থেকে পাওয়া শিল্প
উদ্দীপনাগুলো, এমনকি শব্দপ্রতিমাকে নতুন করে জাগিয়ে তুললেন তার নিজের সৃষ্টিকর্মে।
কর্মজীবনের প্রথমদিকে
বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপিতে কিছুদিন কপি রাইটার হিসেবে চাকরি করলেও পরে আমৃত্যু শিক্ষকতা
করেছেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন
এবং আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব
বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানও ছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
যোগদান করার পর সেলিম আল দীনের উদ্যোগেই ১৯৮৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়
‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগ। একদিকে শিক্ষকতার দায়িত্ব অন্যদিকে লেখালেখি। পাশাপাশি
চালিয়ে যান আবহমান বাংলার লোকজরীতির অনুসন্ধান। গ্রাম থিয়েটারের হয়ে বাংলাদেশের নানা
প্রান্তে ছুটেছেন লোক-নাট্যরীতির সন্ধানে। নিজের নাটকে সেসব প্রয়োগ করে বদলে দেন বাংলানাট্যের
ধারা। আশির দশকের মাঝমাঝি সময় থেকে তিনি গান লেখা শুরু করেন। নাটকের গান তো ছিলই। পাশাপাশি
আরও অনেক গান লিখেছিলেন। তিনি গানকে বলতেন কথাসুর। টিভির জন্যও তিনি লিখেছেন বহু নাটক।
সেলিম আল দীনের লেখা ‘কীর্তনখোলা’ (২০০০) ও ‘চাকা’ (১৯৯৪) নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে চলচ্চিত্র।
করেছেন ‘একাত্তরের যীশু’ (১৯৯৪) চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা।
‘সর্পবিষয়ক গল্প ও অন্যান্য
নাটক’ (১৯৭৩), ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ (১৯৭৫), ‘বাসন’ (১৯৮৫) ‘মুনতাসির’, ‘শকুন্তলা’,
‘কিত্তনখোলা’ (১৯৮৬), ‘কেরামতমঙ্গল’ (১৯৮৮), ‘যৈবতী কন্যার মন’ (১৯৯৩), ‘চাকা’ (১৯৯১),
‘হরগজ’ (১৯৯২), ‘প্রাচ্য’ (২০০০), ‘হাতহদাই’ (১৯৯৭), ‘নিমজ্জন’ (২০০২), ‘ধাবমান’,
‘স্বর্ণবোয়াল’ (২০০৭), ‘পুত্র’, ‘স্বপ্ন রমণীগণ’ ও ‘ঊষা উৎসব’ তার উল্লেখযোগ্য নাটক।
রেডিও-টেলিভিশনেও নাটক
লিখেছেন অনেক। তার মধ্যে- ‘বিপরীত তমসায়’ (রেডিও পাকিস্তান, ১৯৬৯), ‘ঘুম নেই’ (পাকিস্তান
টেলিভিশন, ১৯৭০), ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’ (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি), ‘অশ্রুত গান্ধার’
(বিটিভি, ১৯৭৫), ‘শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য’ (বিটিভি ১৯৭৭), ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ (আয়না
সিরিজ, বিটিভি ১৯৮২-৮৩), ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ (বিটিভি ১৯৯০-৯১), ‘ছায়া শিকারী’ (বিটিভি
১৯৯৪-৯৫), ‘রঙের মানুষ’ (এনটিভি ২০০০-২০০৩), ‘নকশীপাড়ের মানুষেরা’ (এনটিভি, ২০০০),
‘কীত্তনখোলা’ (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫)।
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ
পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। ১৯৮৪ সালে পান বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার,
২০০৭ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, অন্য থিয়েটার (কলকাতা কর্তৃক
প্রদত্ত সংবর্ধনা), নান্দিকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা), ১৯৯৪ সালে শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন
নাট্যকার, ১৩৯০ বঙ্গাব্দে কথক সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা,
‘একাত্তরের যীশু’ শ্রেষ্ঠ সংলাপের জন্য পান জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, ২০০৫ সালে মুনীর
চৌধুরী সম্মাননা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে
বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে যেই মানুষ অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি তিনি সেলিম আল দীন। বিভিন্ন উৎসবের
মূল বাণী ঠিক করে দেওয়া, অনুষ্ঠানের আমেজ অনুযায়ী গান তৈরি করে দেওয়া সবই করতেন তিনি।
তার প্রিয় সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মাটিতেই অনন্তকালের জন্য ঘুমিয়ে
আছেন। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলা নাটকের অবিসংবাদিত পুরুষ সেলিম আল দীন অকালে মৃত্যুর
কোলে ঢলে পড়েন। তার মৃত্যুর খবরে দেশের পুরো সংস্কৃতি অঙ্গন সেদিন শোকে স্তব্ধ হয়ে
যায়।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন