দরজা ঠেলে সৌরভ ঘরে প্রবেশ করলাে , আর হঠাৎ করে ধ্বক করে উঠলাে শেলীর বুকটা ! আগে কখনােই এমন লাগেনি তাে । দূর পাগলী ! আগে বুঝি বিয়ে করেছিলি ? নিজের মনকে শাসন করলাে শেলী ।
কিন্তু এখনো অবিরাম বুকটা ধ্বুকধ্বুক করছেই, আর নিজেকে খুব দুর্বললাগছে শেলীর!
জানালার ধারে দাঁড়ানো নবপরিণীতাকে দেখে আরেক জনের মনে কেমন করছে তার খোঁজ কি করেছে কেউ?
সেই প্রথম দেখার দিনটির মত আজওসৌরভের চোখে বিস্ময়সেই আভা!যেন ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে,মোহাচ্ছন্ন করে ফেলছে চার পাশ!সেইদিনও ছিলো ভরা পূর্ণিমা। মা গঙ্গার আশীর্বাদপ্রাপ্তির জন্যে গর্ভধারিণী মায়ের সাথে পূণ্যস্নানে এসে এক স্বর্গীয় অপ্সরীর দর্শন পেয়েছিল। হয়েছিল চার চোখের মিলন। সেই কাজল কালো চোখের মোহনায় যে ভাষা খেলা করছিলো,শুধু ভাগ্যবানেরাই তা লাভ করতে জানে!
আজ শেলীকে খুব-ই সুন্দর লাগছে। যদিও ওকে আগে দেখেছি তবুও ওর এই মানানসই সাজ-সজ্জা,লজ্জ্বায় আনত মুখ,গভীর কাজলকালো চোখদুটোর মায়াবী চাহনি,সুকোমল বদনখানি আমায় পাগল করে দিচ্ছে ওর স্পর্শ পেতে,ওকে কাছে পেতে,ওর গোলাপের মত পেলব-কোমল তনুর অমোঘ আকর্ষণে আমি আজ মুগ্ধ-বিমোহিত!
আগে তো কখনোই সৌরভ এমন ব্যাকুল হয়ে ওঠেনি। এত অস্থিরতা কাজ করেনি ওর। এমন পিপাসার্ত মনে হয়নি নিজেকে তার। কোন নারীর প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গীও তার মনে উদয় হয়নি,এমন কি প্রেমের সেই দূর্বার দিনগুলোতেও!
সৌরভ প্রশ্ন করে নিজেকে আমি কি শেলীকে ভালোবেসে ফেলেছি? তবে আগের সবকিছু কি ছিলো? শুধুই মোহ যেমনটি মা বলেছিলেন? নিশ্চয়-ই তাই।নয়তো আমার মনের অন্ত:স্থলে বিন্দুমাত্র কষ্ট নেই,অনুশোচনা নেই কেন?কোনো জাদুকাঠির স্পর্শে আমার নতুন জন্ম হল কি তবে?
হঠাৎ বাইরে গর্জন করে মেঘ ডেকে উঠলো আর শেলী ভয় পেয়ে দৌড়ে এসে সৌরভকে জড়িয়ে ধরলো! সৌরভ এতক্ষন যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলো আর শেলীকে নিজের বাহুপাশে আবদ্ধ হিসেবে আবিষ্কার করলো!
ভরা পূর্ণিমার রাত ঢেকে গিয়েছে কালো মেঘের আড়ালে,আর ঝড়ের আগাম পূর্বাভাস দিচ্ছে!
এও নিশ্চয়-ই বিধাতার-ই নির্দেশ। দুটি শুদ্ধ্ব-মুক্ত দেহ-মন ভালোবাসার আবেগে সবকিছু ভুলে শুধুই যেন দুজনের হয়ে ওঠে,তাই তো প্রকৃতির এই রূপবদলের খেলা!
সৌরভের বুকের ধ্বুকধ্বুক শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে শেলী,আর সৌরভ শেলীর উত্তপ্ত ঘন নিশ্বাস!শেলীর মাথা সৌরভের বুকে আর দুন দুহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে একে অপরকে।
সৌরভ এইসময়ের অপেক্ষাতেই তো ছিল। কিন্তু কোন ভূমিকার আর প্রয়োজন পড়েনি। আকাশের চাঁদ মাটির বুকে নিজেই নেমে এসে ধরা দিয়েছে আজ।
অপেক্ষায় ছিল শেলীও। যে মানুষটি তাকে পছন্দ করেনি,যার অমতে এই বিয়ে ঠিক করা হয়েছে,তার এই বদলে যাওয়া রূপ শেলীকে আরো ভীত করে তুলেছে। বারবার মনে হচ্ছে নিশ্চয় তিনি মা-কে খুশি করার জন্যে ছলনা করছেন,মনের বিরুদ্ধে গিয়ে ভালোবাসার অভিনয় করছেন!
সৌরভের বুকে স্থান পেয়ে আজ আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না শেলী। মনের সমস্ত কষ্ট চোখের জলের বাঁধ ভেঙ্গে আজ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সমস্ত অশুভকে,দূর করে দিল দুটি অশান্ত মনের ক্ষোভ-যন্ত্রণাকে আর মিলন ঘটালো দুটি নির্মল হৃদয়ের, যাদের শুধু নিয়তির জন্যেই নয়, বরং একে অন্যের পরিপূরক হয়ে প্রথম দেখা-প্রথম ভালোবাসার পরিপূর্ণতাঘটাতে আর সত্যিকারের প্রেমের মর্যাদা রাখতে এক হওয়ার-ই ছিল!
সৌরভ নবপরিনীতার মুখ তুলে ধরলো। চার চোখের মিলন হলো । আর এবার যেন কামদেব বিদ্ধকরলেন তার প্রেমের তীরে সৌরভ-শেলীকে সেই আদিম-উন্মত্ততাকে আহ্বানকরে যা ব্যতিত সৃষ্টি অপূর্ণ আর প্রেম অতৃপ্ত!
শেলী,তোমায় আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আজ আমার এই জীবন-যৌবন আর শত জনমের সাধনার প্রেম তোমার চরণে নিবেদন করলাম। সত্যি জেনো,তোমায় ভালোবাসা-ই আমার পরম সত্য, তোমার মর্যাদা-ই আমার সম্মান, আর তোমার প্রেমময় গৃহলক্ষ্মীর স্বরূপ-ই আমার সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। তোমায় পেয়ে আমি গর্বিত, আমি ধন্য। এই অধমের প্রেম তুমি স্বীকার করবে কি ওগো স্বর্গের অপ্সরী?
লোকে বলে নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটেনা কিন্তু যেখানে আজ সকল শঙ্কা,সকল পঙ্কিলতার অবসান হলো তবে কেন আর মিছে ভণিতার আড়াল?
শেলী তার সামনে দুবাহু মেলে দাঁড়িয়ে থাকা তার পরম আরাধ্য স্বপ্নপুরুষের আহ্বানেসাড়া দিলো - প্রেমের সূচনাকারী মধুময় চুম্বন নিবেদন করে!
সৌরভও তার সদ্যস্বীকৃত প্রেমের পূর্ণতার প্রতিউত্তর দিলো আবেগঘন চুম্বন আর জীবনসাথীকে বাহুডোরে বেঁধে নিয়ে!
ওগো প্রিয়,সকলে বলে,দানের মন্ত্রে নাকি স্ত্রীকে পাওয়া যায় না। কিন্তু আজ যখন তোমাকে আমার হাতে সম্প্রদান করা হলো,আমাদের গাঁটছড়া বাঁধা হলো,মন্ত্র উচ্চারণ করে দুজনে অগ্নিস্বাক্ষী করে সাতপাকে বাঁধা পড়লুম,তোমার সিঁথি রাঙিয়ে দিলাম লাল সিঁদুরে,বিধিমতে রেজিস্ট্রি করলাম,একবারো তো মনে হলো না যে এ কেবল লৌকিক আচার-বিচার!মনে হলো না যে তোমায় পাইনি!মিথ্যে বলে সবে।
সম্প্রদানের মন্ত্রে আজ তোমায় বরং চিরজীবনের মতো নিজের করে পেলাম,তোমার হাত দুটি যখন আমার হাতে এসে পড়লো,আমার স্বপ্ন যেন স্বার্থক হয়ে ধরা দিলো। শুভদৃষ্টির সময় পানপাতার আড়ালে তোমার বিমুগ্ধ চাহনি আমার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে যেন প্রেমের বাঁশি বাজাতে শুরু করলো আকাশ-বাতাস ধ্বনিত করে! সাতপাকে ঘোরার প্রতিটি মন্ত্র, প্রতিটি মূহুর্তআজ আমাদের জীবনে অক্ষয় হয়ে রইলো!...বলো তবে প্রিয়,তুমিও আমায় বেসেছ কি ভালো?পেয়েছ কি আমায় নিজের করে?... ব্যাকুল কন্ঠে আবেগাপ্লুতো হয়ে সৌরভ জানতে চাইলো শেলীর কাছে।
ওগো,তুমি-ই যে আমার সব,আমার ভগবান,আমার প্রাণনাথ। তোমায় পাবো এ ছিল আমার কল্পনারও অতীত। যেদিন মা গঙ্গা আমার সম্মুখে তোমায় এনে দাঁড় করালো,যেদিন মা আমায় তার পুত্রবধূরস্বীকৃতি দিলো,যেদিন আমাদের আশীর্বাদহলো, সে মূহুর্ত থেকেই যে তুমি আমায় অধিকার করেছো,আর বিয়ের মন্ত্রে জন্ম-জন্মান্তরের জন্য যে তুমি তোমার ভালোবাসার ঋণে আমায় ঋণী করে দিলে!এ বাঁধন আর কোনদিনো যাবেনা ছিঁড়ে!তুমি আমার,আর আমি তোমার!...শেলী উত্তর দিলো।
তারপরকামদেবের নিশানা ব্যার্থ হয়নি। সৌরভ শেলীকে কোলে তুলে নিলো আর দুজনে সেই সজ্জিত বিছানায় লিপ্ত হলো রতিক্রিয়ায়, ঠিক যেভাবে ঋষি বিশ্বজিৎআর অপ্সরী মেনকার মিলন ঘটেছিল!
সূচনা হলো এক নতুন ভোরের, এক নতুন পথের....ভালোবাসার বীজ বপন করে দিয়ে গেলো ভবিষ্যতের নবসম্ভাবনার,....সফল হলো একটি বাসর রাত দুটি শরীর-মনের পরিপূর্ণ সম্মিলনে! সেদিন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রমলা দেবী আর শেলীর কথোপকথন সব-ই শুনেছে সৌরভ।
জেনেছে নিজের জন্মবৃত্তান্ত, তার ও তার সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যে তার পিতা রায়চন্দ্রের আত্মত্যাগ, তাকে মানুষ করতে তার মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম,ত্যাগ আর সাধনার কথা,আত্মীয়-পরিজন সবার বিরোধিতা সত্ত্বেও কোন ধর্মমত সৌরভের উপর চাপিয়ে না দেওয়া,সৌরভকে ত্যাগ না করতে মমতার মত নষ্ট মেয়ের কাছে রমলা দেবীর আকুতি-মিনতির কথা,শেলীর দুঃখ-বেদনা জর্জরিত জীবনের মর্মকথা..........
মূহুর্তেই সৌরভ বিবেকের দংশনে ব্যথিত হয়ে ওঠে। নিজেকে খুব-ই তুচ্ছ মনে হতে থাকে তার।
আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি সকলকে। মা,তোমার আর বাবার ত্যাগ আমাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষাকালীর মতো রক্ষাকরেছে। বাবার আর তোমার কীর্তি অক্ষয় হোক। শেলী,তুমি কেন আগে আসলে না? তবে আমায় ভালোবাসার অমর্যাদা করে অপাত্রে ভিক্ষে চেয়ে বেড়াতে হতো না। আজ আমার মনের সকল অন্ধকার দূর হয়ে গেছে। সত্য ভালোবাসা কি তা আমি জেনেছি। এখন আমাকে আমার সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। তুমি হবেনা আমার সাথী? আমি প্রতীক্ষায় রইলাম।
সৌরভের দায়িত্ব আর প্রতীক্ষা সঠিক রূপেই সম্পূর্ণহলো,আর দুজনের সুখী দাম্পত্যেরকামনায় প্রাণভরে আশীর্বাদদিলেন রমলা দেবী!
শুধু একটি সিদ্ধ্বান্ত সৌরভ স্রষ্টার উপর ছেড়ে দিয়েছে। কারণ তিনি-ই জানেন সে কোন ধর্মের,কোন বর্ণের,কোন সম্প্রদায়ের। তার কাছে কে আগে,কে পরে,কে আপন আর কেই বা পর। তিনি কি আল্লাহ,নাকি ভগবান,নাকি গড,নাকি অন্য কেউ যাকে আসলে-ই কেউজানেনা, দেখতে পায়না,বুঝতে পারেনা তার লীলা? রমলা দেবী যখন সদ্যপ্রসূত সন্তান হারিয়ে পাগলিনী, তখন আরেক সম্প্রদায়ের,আরেক ধর্মের আরেকজন মা-ও সন্তান প্রসব করেন এক-ই নৌকায়,কিন্তু তার আর সৌভাগ্য হয়নি সদ্যপ্রসূত সন্তানকে দেখার ও লালন-পালন করার।
আর সেই মূহুর্মূহু সময়ে কে কার আর কে কার নয় তা জানার বা বোঝার অবস্থাও যে ছিলোনা। তাই রায়চন্দ্র বাবু আর রমলা দেবীর ক্রোড়ে ঠাইঁ হলোসেই পিতৃ-মাতৃ হারা অবুঝ শিশুটির!
কিন্তু কখনই সৌরভকে হিন্দু ধর্মের আচার-বিচার মেনে চলতে হয়নি। হয়নি ধর্ম নিয়ে যেকোন বাড়াবাড়ির সম্মুখীনহতে। হয়নি জবাবদিহি করতে। বরং দেওয়া হয়েছে সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করার শিক্ষা আর যেকোন মতানুসারী হয়ে চলার স্বাধীনতা! কিন্তু পরম মাতৃভক্ত সৌরভ মা-কে যেভাবে নিয়মানুষ্ঠান করতে দেখেছে, তাই মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছে। কিন্তু আজ সব জানতে পেরেও তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি! হলোই না হয় সে অন্য ধর্মের,কিন্তু আজ তার যে পরিচয় সেটাই তো তার অস্তিত্ত্বের পরিচায়ক!তাই ভবিষ্যতের উপরেই না হয় ছেড়ে দেওয়া যাক ন্যায়-অন্যায়,ধর্ম-অধর্মের,পাপ-পূণ্যের বিচার!
একটি অসম সাহসী মা আর এক অসহায় মেয়ের সেবা করার,তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে সুখী দেখার ও নিজে সুখী হওয়ার যে পূণ্যকরার সুযোগ বিধাতা তাকে দিচ্ছেন,এর কাছে পৃথিবীর আর সবকিছুই গৌণ!
সৌরভ প্রাণভরে দেখছে তার পাশে গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন প্রেয়সী-বধূকে। ঘুমন্ত অবস্থায় শেলীকে যে কতটা মায়াবতী লাগছে তা শুধু সেই জানে আজ! যদিও প্রথমেই শরীরীপ্রেমে জড়াবার ইচ্ছে তার ছিলো না,কিন্তু দুজনের প্রেম আর কাছে পাওয়ার আকর্ষণ মানেনি কোন দ্বিধা.... আজ প্রকৃত অর্থেই সফল হলো একটি সত্যিকারের বাসর রাত আর তার গল্পকথার!
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন