ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিপ্লবী
নারী নেত্রী হিসেবে চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব লক্ষ্মী বাঈ। লক্ষ্মী বাঈ ছাড়াও তিনি ঝাঁসীর রাণী বা ঝাঁসী কি রাণী হিসেবে বেশী পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৭ সালের
ভারতীয় বিদ্রোহের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি।
জন্মকালীন সময়ে লক্ষ্মী
বাঈ-এর প্রকৃত নাম ছিল মণিকর্ণিকা
তাম্বে। তিনি ১৮২৮ সালের ১৯ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের মারাঠী উচ্চবর্ণীয় করাডে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ
করেন। তার বাবার নাম ‘মরুপান্ত তাম্বে’ এবং মা ‘ভাগীরথী বাঈ তাম্বে’।
চার বছর বয়সেই মাতৃহারা
হন লক্ষ্মী বাঈ। বাবা বিথুরের পেশোয়া আদালতের কাজ-কর্মে জড়িত থাকায় লক্ষ্মী বাঈ
তার ঐসময়কার নারীদের তুলনায় অনেক বেশী স্বাধীনতা ভোগ করেছিলেন। পারিবারিক পরিবেশে
নিজ বাড়িতে শিক্ষালাভ করেন লক্ষ্মী বাঈ। আত্মরক্ষামূলক শিক্ষালাভের পাশাপাশি ঘোড়া
চালনা, ধনুর্বিদ্যা শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। লক্ষ্মী বাঈ-এর বাবা মরুপান্ত তাম্বে নিজের
কন্যাকে মনের মতো করে গড়ে তুলেন। তিনি লক্ষ্মী বাঈকে আদর করে ছাবিলি নামে ডাকতেন পেশোয়ায় যার অর্থ “ক্রীড়াপ্রেমি
সুন্দরী কন্যা।”
ঝাঁসীর মহারাজা গঙ্গাধর
রাও নিওয়াকরের সাথে ১৮৪২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে লক্ষ্মী বাঈ ঝাঁসীর রাণী হিসেবে পরিচিতি
লাভ করেন। ১৮৫১ সালে তাদের পুত্র সন্তান (দামোদর রাও) জন্ম নেওয়ার চার মাস পর আকস্মিকভাবে
মারা যায়। পুত্র শোক ভুলতে রাজা এবং রাণী উভয়েই গঙ্গাধর রাওয়ের জ্যেঠাতো ভাইয়ের
ছেলে আনন্দ রাওকে দত্তক নেন। ঝাঁসীর মহারাজা গঙ্গাধর রাও ১৮৫৩ সালের ২১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ
করেন।
১৮৫৭ সালে বৃটিশ ভারতের
সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া সিপাহী বিদ্রোহের সময় লক্ষ্মী বাঈ-এর নেতৃত্বে ঝাঁসীতে শান্তিপূর্ণ
অবস্থা বজায় রয়েছিল। হলদী-কুমকুম অনুষ্ঠানে ঝাঁসীর রমণীরা শপথ গ্রহণ করেছিল, যে কোন
আক্রমণকেই তারা মোকাবেলা করবে এবং প্রতিপক্ষের আক্রমণকে তারা ভয় পায় না।
১৮৫৮ সালের ২৩ মার্চ ব্রিটিশ সৈন্যরা স্যার হিউজ রোজের (লর্ড স্ট্রাথনায়র্ন) নেতৃত্বে ঝাঁসী অবরোধ করলে লক্ষ্মী বাঈ তার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেন। ঝাঁসী এবং লক্ষ্মী বাঈকে মুক্ত করতে বিশ হাজার সৈনিকের নিজস্ব একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিদ্রোহী নেতা তাতিয়া তোপে। তবে, বহু সংখ্যক আনাড়ী ও অনভিজ্ঞ সৈনিকদের নিয়েও তাতিয়া তোপে অল্প সংখ্যক প্রশিক্ষিত এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্রিটিশ সৈন্যদের অবরোধ ভাঙ্গতে পারেননি। ঝাঁসী আক্রমণের তিনদিন পর ব্রিটিশ সৈন্যদল দুর্গের দেয়ালে ফাটল ধরায় এবং ঝাঁসী শহরটি দখল করে নেয়। ঝাঁসী দখলের পূর্বেই এক রাতে দুর্গের দেয়াল থেকে সন্তানসহ লাফ দিয়ে লক্ষ্মী বাঈ প্রাণরক্ষা করেন। ঐ সময় তাকে ঘিরে রেখেছিল তার নিজস্ব একটি দল, যার অধিকাংশই ছিল নারী সদস্য।
আনন্দ রাওকে সাথে নিয়ে
রাণী তার বাহিনীসহ কাল্পীতে যান এবং অন্যান্য বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে যোগ দেন। এরপর
রাণী লক্ষ্মী বাঈ এবং তাতিয়া তোপে গোয়ালিয়রের দিকে রওনা দেন। সেখানে তাদের যৌথবাহিনী
গোয়ালিয়রের মহারাজার দলকে পরাজিত করে গোয়ালিয়রের কেল্লা দখল করেন এবং পরাজিত বাহিনীকে
যৌথবাহিনীর সাথে একত্রিত করেন। ১৮৫৮ সালের ১৭ জুন ফুলবাগের কাছাকাছি কোটাহ-কি সেরাইয়ে রাজকীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন
রাণী লক্ষ্মী বাঈ।
ভারতীয় মহিলা কবি সুভদ্রা কুমারী চৌহান রাণী লক্ষ্মী বাঈকে স্মরণ করে লেখা কবিতায় জাতীয় বীরাঙ্গনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাকে ভারতীয় রমণীদের সাহসের
প্রতীক ও প্রতিকল্প হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
সুভাষ চন্দ্র বসু'র নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম নারী দলের
নামকরণ করেন রাণী লক্ষ্মী বাঈকে স্মরণ করে।
১৮৭৮ সালে কর্ণেল ম্যালসন তাঁর “দ্য হিস্ট্রি অব দ্য
ইন্ডিয়ান মুটিনি” পুস্তকে লক্ষ্মী বাঈ বিষয়ে আলোকপাত করে লিখেন,
তার জনগণ সর্বদাই তাঁকে স্মরণ করবে। তিনি নিষ্ঠুরতাকে বিদ্রোহের পর্যায়ে উন্নীত করার
মাধ্যমে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি জীবিত আছেন এবং স্বীয় মাতৃভূমির জন্য নিজের জীবন
বিসর্জন দিয়েছেন।
২০১১ সালের ২১ জুলাই টাইম ম্যাগাজিন লক্ষ্মী বাঈকে (৮ম) বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ডানপিটে রমণীদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা তাদের স্বামীদের কাছ থেকে সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছিলেন। এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন